
স্মার্টফোন হাতে, সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলমলে প্রোফাইল
স্মার্টফোন হাতে, সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলমলে প্রোফাইল, অসংখ্য অনলাইন ফ্রেন্ড সব মিলিয়ে মনে হতে পারে আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সংযুক্ত, অনেক বেশি একে-অপরের পাশে আছি। কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই এমন? প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যেন ধীরে ধীরে আরও একা হয়ে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ এক শূন্যতা আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে নিঃশব্দে।
একদিন যে আড্ডা ছিল বিকেলের চায়ের দোকানে, আজ তা হয়েছে ভার্চুয়াল। যে বন্ধুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে জীবনের গল্প বলা হতো, আজ তার সাথে শুধু রিয়েক্ট বা রিপ্লাই বিনিময় হয়। প্রযুক্তির সংযোগে আমরা যেন হারিয়ে ফেলছি মানবিক সংযোগ ছুঁয়ে দেখার, অনুভব করার, পাশে বসে চুপচাপ সময় কাটানোর চিরচেনা অনুভবগুলো।
ডিজিটাল যুগ আমাদের জীবনকে সহজ করেছে তথ্য এখন হাতের মুঠোয়, কেনাকাটা ঘরে বসে, ক্লাস-পরীক্ষাও অনলাইনে। কিন্তু এই সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর সংকট ‘মানুষে মানুষে দূরত্ব’। এক সময় পরিবার ছিল সন্ধ্যার গল্পের কেন্দ্রবিন্দু, আজ সেখানে সবাই ব্যস্ত নিজের মোবাইল স্ক্রিনে। বাবা-মা সন্তানদের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে বেশি সময় দেন ইউটিউবে; ভাই-বোনের সম্পর্ক এখন “ঝববহ” আর “ঞুঢ়রহমৃ” এর মাঝেই সীমাবদ্ধ।
এই একাকিত্ব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তরুণদের মাঝে। চারপাশে হাজারো লোক থাকলেও, অন্তরে এক ধরনের অস্পষ্ট শুন্যতা কাজ করে। কারো সঙ্গে মন খুলে কথা বলার সুযোগ কমে যাচ্ছে, সম্পর্কগুলো হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী ও পলকা। অনেকে তাই ভার্চুয়াল ভালোবাসা, ফেক অ্যাটেনশন বা ট্রেন্ডি লাইফস্টাইলের পেছনে ছুটে নিজের অনুভূতিকে আড়াল করতে গিয়ে আরও বেশি একা হয়ে পড়ে।
এমনকি প্রযুক্তি আমাদের আত্মপরিচয়ের সংকটেও ফেলছে। ফিল্টার করা ছবি, সাজানো ক্যাপশন, ওভারএডিটেড ভিডিও আমাদের এক কৃত্রিম “আইডেন্টিটি” তৈরি করছে যা বাস্তবের সাথে মেলে না। ফলে নিজের ভেতরের মানুষটির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে, মানসিক চাপ বাড়ে, জন্ম নেয় হতাশা, আত্মবিশ্বাসহীনতা। গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সঙ্গে বিষণœতা ও নিঃসঙ্গতার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
তবে আশার কথা হলো এই একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব নয়। প্রযুক্তিকে আমরা যেভাবে ব্যবহার করছি, তা যদি সামান্য বদলাই, মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সময় দেওয়া, সত্যিকারের যোগাযোগ গড়ে তোলায় মনোযোগ দিই তাহলেই বদলে যেতে পারে চিত্র। মোবাইলের স্ক্রিনের বদলে কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলাটাই হতে পারে কাউকে নতুন প্রাণ দেওয়ার উপায়।
আমরা ভুলে যাচ্ছি, প্রযুক্তি মানুষের বিকল্প নয় এটি মানুষের জন্য। আমাদের দরকার ভারসাম্য: ডিজিটাল জীবন আর মানবিক জীবনের মধ্যে। সম্পর্ক রক্ষায় সময় দেওয়া, অনুভূতির মূল্য দেওয়া, মুখোমুখি বসে কথা বলা এই ছোট ছোট বিষয়গুলোই একাকিত্বের প্রতিষেধক হতে পারে।
শেষ কথা, এই যুগে আমরা যতই উন্নত হই না কেন, মানুষের মৌলিক চাহিদা কিন্তু একই থাকে ভালোবাসা, বোঝাপড়া ও সঙ্গ। তাই সময় এসেছে নিজেদের একটু জিজ্ঞেস করার: “আমি কি সত্যিই কারো খুব কাছের কেউ?” যদি না হতে পারি, তবে প্রযুক্তির বাইরে বেরিয়ে কারো পাশে দাঁড়াই, কারো গল্প শুনি কারণ একাকিত্ব দূর হয় ভালোবাসার ভাষায়, মেশিনের মাধ্যমে নয়।
লেখক : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
প্যানেল