ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গাছ বিলুপ্তির পথে: মানবজাতির অস্তিত্বেই হুমকি

প্রকাশিত: ১৬:০৪, ৪ জুন ২০২৫

বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গাছ বিলুপ্তির পথে: মানবজাতির অস্তিত্বেই হুমকি

ছবি: সংগৃহীত।

বিশ্বজুড়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে পৃথিবীর গাছগাছালি। উপকূলীয় রেডউড থেকে শুরু করে ডাইনোসরের যুগের ওলেমি পাইন, এমনকি বড়দিনের গাছে ব্যবহৃত জনপ্রিয় ফির জাতের গাছ পর্যন্ত—সব ধরনের গাছ আজ চরম হুমকির মুখে। তবে এই গাছের বিলুপ্তি কেবল স্থানীয় বনভূমির ক্ষতি নয়; এটি পুরো পরিবেশব্যবস্থাকেই ঝুঁকিতে ফেলছে বলে সতর্ক করছেন বিজ্ঞানীরা।

২০২১ সালে প্রকাশিত State of the World’s Trees প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গাছ প্রজাতি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এ সংখ্যা প্রায় ১৭,৫০০টি, যা বিপন্ন স্তন্যপায়ী, পাখি, উভচর ও সরীসৃপের সম্মিলিত সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি। কিছু গাছ এতটাই দুর্লভ যে তাদের মধ্যে মাত্র একটি জীবিত উদাহরণ অবশিষ্ট রয়েছে—যেমন মরিশাসের Hyophorbe amaricaulis নামের একটি পাম গাছ।

২০২২ সালে ওই গবেষকরা ২০টি দেশের ৪৫ জন বিজ্ঞানীর সমর্থনে মানবজাতিকে সতর্ক করে বলেন, এই গাছ হারানোর প্রভাব আমাদের অর্থনীতি, জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। বিশ্বের অধিকাংশ ফল, বাদাম, ওষুধের উৎস গাছ। গাছ থেকে প্রাপ্ত অ-কাঠজাত পণ্যের বাণিজ্যিক মূল্য বছরে প্রায় ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উন্নয়নশীল বিশ্বে ৮৮ কোটি মানুষ জ্বালানির জন্য কাঠের ওপর নির্ভর করে এবং ১৬০ কোটি মানুষ বনাঞ্চলের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করে, যারা খাদ্য ও আয়ের জন্য এসব গাছের ওপর নির্ভরশীল। সারা বিশ্বে গাছের অবদান বছরে প্রায় ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সমান হলেও, প্রতিবছর আমরা বিলিয়ন বিলিয়ন গাছ কেটে ফেলছি—চাষাবাদ ও উন্নয়নের জন্য।

গাছ মানে শুধু একটি উদ্ভিদ নয়—প্রতিটি গাছের সঙ্গে যুক্ত থাকে বহু ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, জীবজন্তু ও অন্যান্য উদ্ভিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জৈবিক জগৎ। একটি গাছ হারিয়ে গেলে এই পুরো জগৎও ধ্বংস হয়। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি প্রাণী ও উদ্ভিদ গাছপালাবহুল পরিবেশে বাস করে। ফলে একটি গাছের বিলুপ্তি বহু প্রাণীর জীবনচক্রকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে।

বোটানিক গার্ডেনস কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনালের সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী মালিন রিভারস বলেন, “যখন কোনো প্রাণী বা পাখির বিলুপ্তির কথা ভাবি, তখন তার মূল কারণ হয় গাছ হারানো।”

বৈচিত্র্য হারালে জীবনব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। কম জেনেটিক বৈচিত্র্য মানে পরিবেশগত পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দুর্বলতা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস এবং বিপর্যয়ের মুখে পড়া।
উদাহরণস্বরূপ, Dracaena cinnabari নামের ‘ড্রাগন ব্লাড’ গাছগুলো এমন এক বিশেষ বাস্তুতন্ত্রের ভিত্তি, যেগুলো বহু প্রাণী ও উদ্ভিদের একমাত্র আশ্রয়। এমন গাছ হারালে বহু নির্ভরশীল প্রজাতিও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭০ সাল থেকে বননির্ভর প্রজাতিগুলোর সংখ্যা প্রায় ৫৩ শতাংশ কমেছে, এবং আরও অনেক বন আজ গভীর সংকটে।

গাছ আমাদের বাতাস পরিষ্কার করে, অক্সিজেন সরবরাহ করে, বৃষ্টি আনে। তারা বিশ্বের ৭৫% পরিচলনযোগ্য মিঠা পানি এবং ৫০% এর বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড ধরে রাখে।
তাই বিপুল সংখ্যায় গাছ হারিয়ে গেলে পৃথিবীর পানিচক্র, পুষ্টি চক্র ও জলবায়ুর ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

রিভারস বলেন, “বহু গবেষণায় দেখা গেছে, বৈচিত্র্যপূর্ণ বন বেশি কার্বন ধরে রাখতে পারে। শুধু কার্বন নয়, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, মাটির স্থিতিশীলতা, রোগ-ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, এবং জলবায়ু বৈরিতার বিরুদ্ধে সহনশীলতা—সবক্ষেত্রেই বৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ।” কিছু গাছ দ্রুত পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে—যেমন আগুনে পুড়ে যাওয়া অঞ্চলে নতুন করে প্রবেশ করছে। কিন্তু অধিকাংশ প্রজাতিই ধ্বংসের পথে।

গবেষকরা বলছেন, আমাদের সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের ব্যক্তি পর্যায়েও গাছের গুরুত্ব বোঝা ও গাছ-অজ্ঞতা (plant blindness) দূর করতে হবে।
দুঃখজনকভাবে, যুক্তরাজ্যে উদ্ভিদ বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে—যেখানে প্রকৃতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে গাছের ওপর। আমাদের প্রত্যেকের উচিত এখনই গাছের কথা ভাবা।

সূত্র: https://urli.info/-y5w

মিরাজ খান

×