
ছবি: প্রতীকী
বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য ঈদুল আজহা একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব। এই ঈদে কোরবানির পশু কেনা ও তা ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী উৎসর্গ করাই উৎসবের মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু যেহেতু এই ঈদ প্রায়শই বর্ষাকালে পড়ে, তাই গরুর হাট এবং কোরবানির প্রস্তুতি ঘিরে তৈরি হয় এক জটিল বাস্তবতা যেখানে একদিকে মানুষের ধর্মীয় প্রত্যাশা ও উৎসাহ, অন্যদিকে রয়েছে প্রকৃতির প্রতিকূলতা ও সামাজিক-নগরপরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতা।
একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে কোরবানির পশু কেনা কেবল কেনাবেচা নয়; এটি একটি আত্মিক ত্যাগ ও ধর্মীয় আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ। মানুষ আশা করে যে তারা একটি সুস্থ, হালাল ও নিখুঁত পশু কিনতে পারবে, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা হবে। অনেকে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বড় ও আকর্ষণীয় গরু কেনার চেষ্টা করেন, যা সামাজিক মর্যাদা ও ধর্মীয় আত্মতৃপ্তির প্রতিফলন। এর পাশাপাশি মানুষ চায় একটি নিরাপদ, পরিষ্কার, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হাট ব্যবস্থা।
বর্ষাকালের প্রবল বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা গরুর হাটগুলোকে করে তোলে কাদা ও দুর্গন্ধে ভরা এক দুর্বিষহ স্থান। দেশের বেশিরভাগ গরুর হাটই অস্থায়ী ও উন্মুক্ত, যার ফলে বৃষ্টি হলে কাদা জমে গিয়ে মানুষের চলাচল এবং পশু দেখার কার্যক্রম ব্যাহত হয়। হাটের ভেতর প্রবেশ করতেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে; অনেক জায়গায় হাঁটু-সমান কাদা, অপর্যাপ্ত আলো ও অস্থায়ী বৈদ্যুতিক তারের ঝুঁকি ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জীবন বিপন্ন করে তোলে।
ভিজে ও অপরিষ্কার পরিবেশ পশুর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘ সময় ভেজা জায়গায় থাকায় গরু সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে কোরবানির পশুর হালাল অবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ করে। পাশাপাশি, হাট থেকে পশু পরিবহনের সময় রাস্তাঘাট কাদায় নষ্ট হয়ে থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং পশুর শরীরেও আঘাত লাগে। অন্যদিকে, হাটের পাশে বাসাবাসকারী মানুষের জন্য সৃষ্টি হয় দুর্গন্ধ, মশার উৎপাত ও জলবাহিত রোগের আশঙ্কা।
বর্ষাকালে গরু কেনার পর ক্রেতাদের সবচেয়ে বড় ভোগান্তি হয় পশু পরিবহন নিয়ে। অনেক সময় হাটে ট্রাক বা গাড়ি পৌঁছাতে পারে না; আবার রাস্তার কাদায় আটকে গরু ও মানুষ দুই-ই পড়ে চরম বিপাকে। ট্রাফিক জ্যামের কারণে শহরে পশু নিয়ে প্রবেশ করতেই লেগে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেক সময় গরু পথেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, যার ফলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন ক্রেতারা। এই সমস্যাগুলোর মূল কারণ হাট ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও নগর পরিকল্পনার অদক্ষতা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইন গরুর হাট বা ডিজিটাল কোরবানি প্ল্যাটফর্ম মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বিশেষত বর্ষাকালে ঘরে বসেই গরু বেছে নেওয়ার সুবিধা অনেকেই নিতে শুরু করেছেন। যদিও এতে পশু প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ নেই, তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও যাচাইকৃত বিক্রেতা থাকলে এটি হতে পারে একটি কার্যকর বিকল্প। পাশাপাশি, হাট স্থাপনকালীন আধুনিক নিকাশি ব্যবস্থা, পাকা রাস্তা, অস্থায়ী ছাউনিসহ পর্যাপ্ত সেবাদানকারী দল (চিকিৎসা, নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা) থাকলে বর্ষার প্রভাব অনেকটা কমানো সম্ভব।
এই জটিলতা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ জরুরি। প্রতিটি বড় শহরের পাশে আধুনিক গরুর হাট স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা দরকার। বর্ষা মাথায় রেখে হাটের পানি নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজন প্রযুক্তি ও জনবল। তাছাড়া, অনলাইন হাট ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে সাধারণ মানুষকে এর প্রতি আকৃষ্ট করা যেতে পারে। মিডিয়ার ভূমিকা, স্থানীয় প্রশাসনের প্রস্তুতি ও জনসচেতনতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্ষাকাল যেমন প্রকৃতির এক অনিবার্য অংশ, তেমনি ঈদুল আজহার ধর্মীয় অনুশীলনও অপরিহার্য। এই দুইয়ের সংঘাতে মানুষের যে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়, তা শুধুমাত্র সঠিক পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব। এক পবিত্র ইবাদতের আনন্দ যাতে মানুষের জীবনে দুর্ভোগের ছায়া না ফেলে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া কর্তব্য রাষ্ট্র, সমাজ এবং প্রতিটি নাগরিকের।
এম.কে.