ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সবুজ প্রযুক্তি

পরিবেশ রক্ষায় ভবিষ্যতের হাতিয়ার

শিব্বির আহমেদ তাশফিক

প্রকাশিত: ১৮:১২, ৪ জুন ২০২৫

পরিবেশ রক্ষায় ভবিষ্যতের হাতিয়ার

বিশ্ব পরিবেশ দিবস প্রতিবছর পালিত হয় ৫ জুন। পৃথিবীর মানুষকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করার এক মহৎ উপলক্ষ হিসেবে। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এই দিনটি পালন করছি, তখন আমাদের চারপাশে আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব, জীববৈচিত্র্যের হ্রাস, বন উজাড়, নদী-নালা ও সমুদ্রদূষণ- এসব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন এক গভীর আর্তনাদ করছে। এবারের পরিবেশ দিবসে আমাদের ভাবনা হওয়া উচিত কেবল সমস্যাগুলো চিহ্নিত নয়, বরং এর সৃজনশীল সমাধান কী হতে পারে।
সবুজ প্রযুক্তি (Green Technology) হলো এমন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন যা পরিবেশের ক্ষতি না করে, বরং পরিবেশবান্ধব উপায়ে মানবজীবন সহজ করে তোলে। এটি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার, পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ, দূষণমুক্ত উৎপাদন ও পরিবহনব্যবস্থা এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর দিকে নজর দেয়।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় এখন ‘সবুজ প্রযুক্তি’ আর বিলাসিতা নয়- এটি সময়ের দাবি। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য এটিই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পথ।
বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা ও খরার প্রকোপ আমাদের পরিবেশ ও অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শুধু বনভূমি ধ্বংস নয়, শিল্প-কারখানার বর্জ্য, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক ব্যবহারে মাটি ও পানির গুণগত মানও নষ্ট হচ্ছে।
এখনই যদি আমরা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, কৃষিপদ্ধতি ও নগর পরিকল্পনা গ্রহণ না করি, তবে অদূর ভবিষ্যতে এর ফল হবে ভয়াবহ। তাই সময় এসেছে, আমরা সবুজ প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ দেই। উল্লেখযোগ্য কিছু সবুজ প্রযুক্তি হলো-
সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি : গ্রামাঞ্চলে সৌর প্যানেল স্থাপন ও বায়ুশক্তিনির্ভর টারবাইন পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম উপায় হতে পারে। এটি গ্রিডের ওপর নির্ভরতা কমায় এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে।
সবুজ কৃষি প্রযুক্তি : জৈব সার ও কমপোস্ট ব্যবহার, জৈব কীটনাশক, স্মার্ট-সেচ পদ্ধতি : এসব সবুজ কৃষি প্রযুক্তি মাটি ও পানির গুণমান বজায় রাখে।
ইকো-ফ্রেন্ডলি নির্মাণ : ভবন নির্মাণে হালকা ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ যেমন- বাঁশ, পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাচ, সৌরচালিত পানি গরম করার ব্যবস্থা এখন সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি : আধুনিক বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি (Waste-to-energy, Bio-digesters) শহরগুলোর পরিবেশ দূষণ অনেকাংশে কমাতে পারে।
বাংলাদেশের বনভূমি বর্তমানে মোট ভূমির প্রায় ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশজুড়ে বিস্তৃত, যা জাতিসংঘের সুপারিশকৃত ২৫ শতাংশ বনভূমির তুলনায় অনেক কম। বন উজাড়, অবৈধ কাঠ পাচার, নগরায়ণ ও কৃষি সম্প্রসারণের কারণে বনভূমি হ্রাস পাচ্ছে। 
এমতাবস্থায় সবুজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন সংরক্ষণে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রযুক্তি হলো- ড্রোন ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তি- ড্রোন ও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বনাঞ্চলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও অবৈধ কাঠ চুরি শনাক্ত করা সম্ভব। স্মার্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট- আইওটি (IoT) প্রযুক্তির মাধ্যমে বনাঞ্চলের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও অন্যান্য পরিবেশগত তথ্য সংগ্রহ করে বনের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা যায়। বনভিত্তিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ- বনাঞ্চলে বাস করা প্রাণীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি এবং তাদের খাদ্য চক্র রক্ষা করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা উচিত। 
সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন পরিবেশের জন্য ভালো, তেমনি এর বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন- প্রযুক্তির উচ্চ মূল্য, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, সচেতনতার ঘাটতি, সরকারি নীতিমালার দুর্বলতা। তবে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির সংযোজন এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো জয় করা সম্ভব।
সবুজ প্রযুক্তির প্রসারে তরুণ সমাজের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি স্কুল-কলেজ থেকেই পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবন, গবেষণা এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকে মনোনিবেশ করে, তবে আগামী দিনে বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার একটি ‘সবুজ প্রযুক্তি কেন্দ্র’।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গ্রিন ইঞ্জিনিয়ারিং, পরিবেশ প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর আরও বেশি গবেষণা ও স্টার্টআপ উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রিন হ্যাকাথন, ইকো-চ্যালেঞ্জ, বিশ্ববিদ্যালয় উৎসব ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী শক্তিকে উজ্জীবিত করা যেতে পারে। 
২০২৫ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের শপথ হোক- আমরা শুধু গাছ লাগাব না, আমরা প্রযুক্তিকে সবুজ করব। পরিবেশ নিয়ে ভাবা মানেই শুধু প্রকৃতিকে রক্ষা করা নয়। মানব সভ্যতার টিকে থাকার সংগ্রাম। এই সংগ্রামে প্রযুক্তি হতে পারে আমাদের সবচেয়ে বড় মিত্র। আমাদের বন, আমাদের বাতাস, নদী, সাগর এবং প্রাণীকুল- সবকিছু বাঁচাতে হলে উন্নয়নের গতিকে পরিবেশবান্ধব করতে হবে। সবুজ প্রযুক্তির দিগন্ত উন্মোচনের এটাই সেরা সময়। পরিবেশ রক্ষা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এ দায় আমাদের সবার। একটি সবুজ, নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যতের জন্য আসুন আমরা সকলে ‘সবুজ প্রযুক্তির’ অগ্রসেনানী হই।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
[email protected]

প্যানেল

×