
ছবি: সংগৃহীত
মা একটি শব্দ, এই একটি শব্দের গভীরতা অনেক বেশি। মায়ের আদর স্নেহ, আর শাসনে প্রতিটি সন্তান বেড়ে ওঠে। কারণে অকারণে মা মা বলে ডাকা প্রতিটি সন্তানের স্বভাব। মাকে পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানে রাখে প্রতিটি সন্তান। প্রতিটি সন্তানই তার মায়ের কাছে শেখে তার মুখের ভাষা। মা জীবনের প্রথম দিন থেকেই আমাদের জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে যান। মা হয় প্রতিটি সন্তানের প্রথম শিক্ষক, তার আলোয় আলোকিত হয় প্রতিটি সন্তানের জীবন। সন্তানদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্রয়ের জায়গা ও জীবনের পরম বন্ধু মা।
কিন্তু এমনও মা- বাবা আছে তারা তার সন্তানকে অন্য মানুষের কাছে দত্তক দেয়। মায়ের সাথে প্রতিটি সন্তানের নাড়ীর টান আর বাবার থাকে রক্তের। কিন্তু এই মায়া ত্যাগ করে অন্যজনের কাছে কীভাবে তাদের সন্তানকে দত্তক দিতে পারে? এমন প্রশ্নের উত্তর মেলানো খুবই কঠিন ব্যাপার।
এমনই একটি সত্য ঘটনা তুলে ধরার চেস্টা করেছে এই প্রতিবেদক ছদ্মনাম নাম (ময়না) বয়স হয়ত ৩-৪ বছর হবে। খুবই সামান্য স্মৃতি মনে পড়ে তাদের বাড়ি দিনাজপুর জেলার কোন একটা জায়গায় ছিল। মা-বাবা গরিব হওয়ায় তাদের সংসার চালানো ছিলো কঠিন। তাই তাকে দত্তক দিয়ে দেয় তার পরিবার।
আনুমানিক ২০০৪ বা ২০০৫ সালের কোন এক বৈশাখ মাসে তাকে দত্তক দেওয়া হয়। সেই পাঁচ বছরের ময়না তার আপন মা-বাবাকে ছেড়ে আসতে চায় নাই। তবুও আসতে হয়েছে ( ময়না কান্না করছে) গাড়িতে তোলা হয় ময়নাকে। যে মানুষ তাকে জন্মদিল তারাই তাকে আরেকজনের কাছে দত্তক দিয়ে দিলো। অনেক কষ্ট পাওয়ার কথা ময়নার, ময়না খুবই কষ্ট পেয়েছে বলে জানায় আমাদের।
তার এই স্মৃতি চারণ আমাদেরও দুঃখের সাগরে ডুবিয়ে দেয়। ময়না কান্না করে বলছে তার সেসময়ের কথা। ময়না বলে আমাকে একটি মাইক্রো গাড়িতে করে নিয়ে আসা হল। আমি আসলাম যেখানে সবাই নতুন মানুষ আমি কাউকে চিনি না।
আমার যে মা হলো, সে আমাকে অনেক আদর যত্ন, আর স্নেহ করা শুরু করে। আমি আমার এই মায়ের আদর স্নেহ আর ভালোবাসা অল্প অল্প করে বুঝতে পারি। আমি নতুন মা পেলাম নতুন বাবা পেলাম। আমি সহজে আমার আপন মা-বাবাকে ভুলতে পারি না। আমি নতুন মা-বাবার কাছে থাকতে থাকতে তারাই আমার আপন মা-বাবা হয়ে গেলো।
আমি নতুন এক পরিবার পেলাম। ভুলে যেতে চাইলেও আমার আপন মা-বাবাকে ভুলতে পারি না, তাদের প্রতি আমার আকাশ পরিমাণ ঘৃণা জন্ম হয়েছে। তারা আমাকে লালনপালন করতে পারবে না, তাহলে আমাকে কেন পৃথিবীতে নিয়ে আসল? এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ময়না। আমি নতুন পরিবারে এসেছি এমনটা আমার নতুন মা কখনো বুঝতে দেয় নাই। আমাকে সে অনেক অনেক ভালোবাসা দিয়েছে।
আমার দেখাশোনার জন্য আমার একটা বড় বোন নিয়ে এসেছিল, সে আমাকে সব সময় দেখাশোনা করত। আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা, খাবার রান্না করে আমাকে খাওয়ানো। আম্মু তার কাজ শেষ করে আমার সাথে খেলাধুলা করত, আমাকে সময় দিত আমাকে বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে নিয়ে যেত।
কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস আমি যার এত ভালোবাসা পেলাম তাঁকেও আমি আমার ৮-৯ বছর বয়সে হারিয়ে ফেললাম। আমার মা ২০১২ সালের দিকে রাতে বুকে ব্যথা বলতে বলতে সে রাতেই মারা গেলো। আল্লাহ আমাকে মা দিলো কিন্তু আমার কাছে থাকতে দিল না। আমি আবার মা হারিয়ে ফেললাম। মায়ের আদর ভালোবাসা থেকে আবার আমি বঞ্চিত হলাম।
আমার এই বয়সে আমার মাকে খুব দরকার, কিন্তু সে কপাল আমার নাই। মায়ের আদর, ভালোবাসা শাসন কোনো কিছুই আমি পেলাম না। এই পরিবারে এসে আমি চাচা-চাচি চাচাতো ভাই বোন পেলাম। তারা এখনো আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমার মা কই? আমার মাকে তো খুঁজে পাই না আমি।
মা ছাড়াই জীবন চলতে থাকল। আবার আব্বু নতুন বিয়ে করল, নতুন মা সম্পর্কে কিছুই বলব না, শুধু বলব মা তৃতা না মিঠা আমি কিছুই জানি না।
আমার বিয়ে হয়েছে আমি বর্তমান বিবাহিত আমার সন্তান আছে। একটি মেয়ের সবচেয়ে মাকে প্রয়োজন হয় যখন সে সন্তানের জন্ম দিবে সেসময়। কিন্তু আমি? আমি আমার মাকে এইসময়ও পেলাম? (কান্না জড়িত কণ্ঠে)। আমার স্বামী, শ্বশুর -শাশুড়ি, দেবর- ননদ সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার সন্তান পেটে আসার পর আমার কোন কিছু ভালো লাগতো না। আমার অন্যরকম মনে হত, আমি হয়তো বেঁচে থাকব না। এই রকম মনে হত।
আমি আমার মনের কথাগুলো কাউকে বলতে পারতাম না। আসলে যে কথাগুলো আমার মাকে বলার দরকার আমি সেগুলো বলতে পারি নাই। আমার বাবু পেটে থাকা অবস্থায় একদিন খুবই অসুস্থ হয়ে যাই, আবার শ্বশুর আবার বর্তমান মাকে ফোন দেয় আব্বুকে ফোন দেয় কেউই সাড়া দেয় না৷ বাবা তাও আসল মাত্র ৫ মিনিট হাসপাতালে থেকে চলে গেল, আমি বুঝতে পেরেছি বাবা কি জন্য চলে গেছে, সে কথা আর আমি বলতে চাই না।
কত মেয়ে কে দেখি তার বাবার বাড়ি যায়, তার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে, মায়েরা তার মেয়েকে কত বার বলে তুই কবে আসবি বাসায়, আয় বাড়িতে এসে কয়দিন থেকে যা। আমি তোর শ্বশুর-শ্বাড়িকে ফোন দিয়ে বলছি, জামাই যেন এসে তোকে রেখে যায়। কত আদর ভালোবাসা, আসলে সবার কপালেই তো আর সব কিছু জোটে না, আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।
আল্লাহর কাছে বলি, আল্লাহ আপনি আমাকে এমন জীবন দিয়ে যদি খুশি থাকেন, আমি আপনার দেওয়া এই জীবন পেয়েও খুশি। পরিস্থিতি মেনেই চলতে হয়। আমিও তাই পরিস্থিতি বুঝেই চলার চেষ্টা করি।
বিয়ের পর মা-বাবার বাড়ি যাওয়ার সখটাই একটা মেয়ের বেশি থাকে, আমি যেতে পারি না। যেতে পারি না বললে ভুল, যাই তবে আমাকে ফোন করে বলে না যে এই সাপ্তাহে বাড়িতে আসো, কয়দিন থেকে যাও, এইসব আমার কপালে নাই। আমি মাঝে মাঝে ফোন দেই, তারাও দেয় ঐ তো দায় সাড়া কাজের মত।
আমার অনেক কথা বলার আছে, আমি বলেই বা কি করব? আমি আর কাউকে আমার বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। আমি আমার সন্তান-স্বামী নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। তবে একটা অনুরোধ আমি করবো, আমি এখন মা হয়েছি আমি বুঝতে পারি একটা সন্তানের তার মাকে কতটা প্রয়োজন। প্রতিটি সন্তান যেন তার মা-বাবার আদর স্নেহ, ভালোবাসা আর শাসনে বড় হয়ে মানুষের মত মানুষ হতে পারে সেই দোয়া করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিক, দোয়া করি।
সকল মায়ের প্রতি আমার গভীয় শ্রদ্ধা, আর আমার মৃত মায়ের জন্য দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন। আমার মা বেঁচে থাকলে হয়তো আমার পরিস্থিতি আমার অবস্থা অন্য ৫ টা মেয়ের মত স্বাভাবিকই হতো।
ফারুক