
‘ফ্যাক্ট চেকিং’ বা ‘সত্যতা যাচাই’ গণমাধ্যমের একটি সম্পাদকীয় কৌশল
‘ফ্যাক্ট চেকিং’ বা ‘সত্যতা যাচাই’ গণমাধ্যমের একটি সম্পাদকীয় কৌশল, যার মাধ্যমে সম্পাদক, সাংবাদিক এবং ফ্যাক্ট চেকাররা কোনো ঘটনা, তথ্য বা বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করে থাকেন। গণমানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া একটি সংবাদ বা তথ্য সত্য কি মিথ্যা, সংবাদ বা তথ্যটি যথার্থ নাকি ভুল তথ্য, কুতথ্য, অপতথ্য, গুজব, অপপ্রচার অথবা ভুয়া সংবাদ এসব চিহ্নিত, যাচাই এবং প্রচার করাই হচ্ছে ‘ফ্যাক্ট চেকিং’। পেশাদার সাংবাদিকতার জন্মলগ্ন থেকেই সাংবাদিকরা তথ্য বা ঘটনার সত্যতা যাচাই করে তা সংবাদে রূপান্তরিত করে আসছেন।
কিন্তু বর্তমান সময়ে সাংবাদিকদের সংখ্যা এবং সংবাদপত্র (অফলাইন, অনলাইন), ফেসবুকসহ নানা উৎসের সংখ্যা এত বেড়েছে যে, সংবাদের সত্যতা নিয়ে প্রায়ই নানা প্রশ্ন উঠে। ভুয়া ছবি ও সংবাদের জোড়া-তালির (কাট-পেস্ট) এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায় কিছু নাম সর্বস্ব সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের। বিশেষ করে ফেসবুকে। তাই ভুয়া তথ্য ছড়ানো ঠেকাতে থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট-চেকিং কর্মসূচি চালু করেছে ফেসবুক নিজেই। ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (আইএফসিএন) অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ‘বুম বাংলাদেশ’ এর সঙ্গে অংশীদার হয়ে ফ্যাক্ট-চেকিং করছে ফেসবুক। এটি মূলত ভারতীয় ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান ‘বুম লাইভ’ এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান, যা ২০২০ সালে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে। নিজস্ব ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেইজ, ইনস্টাগ্রাম, এক্স (টুইটার) ইত্যাদি মাধ্যমে সংস্থাটি ভুয়া তথ্যের বিস্তার রোধে কাজ করে যাচ্ছে।
বুম বাংলাদেশের ফেসবুক কমিউনিটিতে বিদ্যমান ছবি ও ভিডিওসহ ফেসবুক স্টোরিগুলোর যথার্থতা পর্যালোচনা করে এবং সঠিক কিনা তার রেটিং করে দেয়। যদি কোন পোস্ট অসত্য বা ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়, তবে সেটি নিউজ ফিডে কম বা একেবারে নিচের দিকে প্রদর্শিত হয়। এতে পোস্টটির ছড়িয়ে পড়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। উল্লেখ্য, ফেসবুকের ফ্যাক্ট চেকিং কর্মসূচি ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে ৫০টির বেশি ভাষায় তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিশ্বখ্যাত অপর আরেকটি ফেক চেকিং প্রতিষ্ঠান এএফ কার্যক্রম শুরু করে ২০১৭ সালে।
এএফপি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২৬-টি ভাষায় ইন্টারনেটে ছড়ানো বিভিন্ন তথ্য পর্যবেক্ষণ করে থাকে। পরবর্তীতে স্থানীয় বা আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে প্রতিবেদন তৈরি ও সম্পাদনা এবং প্যারিস হেডকোয়ার্টার থেকে সমগ্র কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এএফপি ফ্যাক্ট চেকের বাংলা বিভাগ বাংলাদেশ ও বাঙালি অধ্যুষিত অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পরা বিভিন্ন গুজব ও ভুল তথ্যের ফ্যাক্ট চেকের পাশাপাশি বহির্বিশ্বের আলোচিত বা ভাইরাল বিভিন্ন ঘটনা নিয়েও বাংলায় প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উল্লেখ্য, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কিছু গণমাধ্যমে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের জন্য আলাদা বিভাগ চালু করে।
কিন্তু সেসময় ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম না থাকায় তথ্যের প্রবাহ এখনকার মতো এত বিস্তৃত ও মসৃণ ছিল না। ফলে সংবাদের যথার্থতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিতকরণে গণমাধ্যমগুলো তাদের নিজস্ব নিয়মে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ফ্যাক্ট চেকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতো। অবশ্য গণমাধ্যমগুলো তখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল তথ্য বা ভুয়া সংবাদ প্রচার করতো না।
গত শতকের শেষে ইন্টারনেট এবং একুশ শতকে এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বিস্তার তথ্যের প্রবাহকে উন্মুক্ত করে দেয়। এসব মাধ্যমে তথ্য প্রচারে একদিকে যেমন সম্পাদনা ও প্রকাশনা নীতির তেমন কোনো বালাই নেই। অন্যদিকে প্রচারের স্থান-কাল নিয়েও নেই কোনো ধরাবাধা নিয়ম। আজও মূলধারার গণমাধ্যমগুলোকে যেখানে রাষ্ট্র ও সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়মে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়, সেখানে ইন্টারনেট ভিত্তিক মাধ্যমগুলোতে তথ্য প্রচারে তেমন কোনো বিধিবদ্ধ তৈরি হয়নি। ফলে যে কেউ চাইলেই বিশ্বের এক প্রান্তে বসে আরেক প্রান্তে যা ইচ্ছা তা প্রকাশ ও প্রচার করতে পারে।
এ সুযোগে আজকাল গুজব, ভুল তথ্য ও ভুয়া সংবাদ বেশ লক্ষ্য করা যায়, যা প্রযুক্তিগত কারণে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তাই প্রয়োজনের তাগিদে ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ প্রক্রিয়া গণমাধ্যম থেকে স্বতন্ত্র রূপে আবির্ভূত হয়েছে হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো ‘বিডি ফ্যাক্ট চেক’। দেশীয় গণমাধ্যম ‘বিজনেস স্টান্ডার্ড’ এদের সঙ্গে কাজ করে আসছে ২০২০ সাল থেকে। ‘আজকের পত্রিকা’ও ২০২১ সাল থেকে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অন্যান্য পত্রিকাতেও এ ধরনের কর্মসূচি চালু আছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞান-বিষয়ক জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম সায়েন্স বী-র পোর্টাল ‘বিজ্ঞান সংবাদ’-এ বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিভিন্ন দাবির ফ্যাক্ট চেক করে থাকে।
‘যাচাই’ ২০১৭ সালে ‘যাত্রা শুরু শুরু করে। ‘মিডিয়া ওয়াচ’ বা গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদন ও ফটোকার্ডের জন্য সংস্থাটি পাঠকদের কাছে বেশ সমাদৃত। ‘ফ্যাক্ট ওয়াচ’ আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (আইএফসিএন) কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রথম ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব)-এ ২০১৭ সালে আত্মপ্রকাশ করে। অলাভজনক এই সংস্থাটি প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশে অবস্থিত আমেরিকান সেন্টারের আর্থিক সহায়তায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে সংস্থাটি ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান ‘মেটা’-র বাংলাদেশ বিষয়ক অন্যতম ‘ফ্যাক্ট চেকিং পার্টনার’ হিসেবে কাজ করছে।
২০২০ সাল থেকে আইএফসিএন এর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দ্বিতীয় ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা হিসেবে কাজ করছে ‘রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ’। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে সক্রিয় ও জনপ্রিয় এই ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাটি নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ডিজিটাল ব্যানার প্রচারের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সংস্থাটির ফেসবুক পেজে প্রায় সাত-আট লাখ অনুসারী এবং লক্ষাধিক সদস্যের একটি গ্রুপ রয়েছে, যা ফ্যাক্ট চেকিং নিয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কমিউনিটি। সম্প্রতি তারা হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন চালু করেছে, যেখানে পাঠকরা বিভিন্ন পোস্ট, ভিডিও এবং সংবাদের লিংক পাঠিয়ে ফ্যাক্ট চেকের অনুরোধ জানাতে পারে।
বর্তমানে তথ্য আদান-প্রদান এবং সংবাদ প্রচারÑ সকল কিছুই ইন্টারনেট নির্ভর। এতে তথ্য প্রবাহ ব্যাপক গতিশীলতা পেলেও সম্পাদনা এবং নিয়ন্ত্রণের অভাবে প্রচুর ভুল তথ্য ও সংবাদ ছড়িয়ে যায় সহজে। বিশেষত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ ধরনের তথ্যের ছড়াছড়ি জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সেই বিবেচনায় তথ্যের নিন্মোক্ত ধরনগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাক্ট চেকের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যথা: ১. ভুল তথ্যÑ প্রথাগত ধারণা এবং লোক-মুখে শোনা কথা থেকে মূলত ‘ভুল তথ্য’-র উদ্ভব ঘটে এবং ব্যতিক্রম বা অভিনবত্বের প্রতি মানুষের ঝোঁকের কারণে তা ছড়িয়েও পড়ে। ২. কুতথ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে ভুল তথ্য ছড়ানো হলে তা ‘কুতথ্য’।
অর্থাৎ তথ্যদাতা যখন জানা সত্ত্বেও একটি ভুল তথ্য প্রচার করে, সেটি ‘কুতথ্য’ বলে গণ্য হয়। ৩. অপতথ্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে সঠিক তথ্যকেই বিকৃত বা ভিন্নার্থবোধকভাবে প্রচার করা হলে, তা হবে ‘অপতথ্য’। ৪. গুজব এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে রটনা, জনরব, মুখে মুখে রটে যাওয়া কথা ইত্যাদি। প্রচলিত অর্থে ‘গুজব’ মানে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বা বানোয়াট, যা লোক-মুখে ব্যাপকভাবে রটে। অপপ্রচার- ‘অপপ্রচার’ বা ‘প্রোপাগান্ডা’ হচ্ছে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক বা আদর্শিক উদ্দেশ্য, স্বার্থ কিংবা প্রভাব অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত প্রচারণামূলক কর্মকা-, যা নেতিবাচক বা ইতিবাচক উভয় অর্থই ব্যবহৃত হতেই পারে। ভুয়া সংবাদ ভুয়া সংবাদ বলতে মূলত বোঝানো হয়, ভুল তথ্যের ভিত্তিতে প্রচারিত সংবাদ কিংবা বানোয়াট বা ভিত্তিহীন সংবাদ। অর্থাৎ যেসব সংবাদের তথ্যের সত্যতা থাকে না কিংবা মনগড়া তথ্য দিয়ে সংবাদ সাজানো হয়, সেগুলো ভুয়া সংবাদ।
তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে তথ্যের সত্যতা ও যথার্থতা নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভুল তথ্য ও ভুয়া সংবাদের বিস্তার রোধ, গুজব ও অপপ্রচার রোধ, সত্য ও সঠিক তথ্যের প্রচার, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা, জনসচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়গুলো নিশ্চিন্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ এর মাধ্যমে- এমনটাই সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়