ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শিশু শিক্ষায় অব্যবস্থাপনা

মো. তানজিমুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৮:১৬, ১ জুন ২০২৫

শিশু শিক্ষায় অব্যবস্থাপনা

ডিজিটাল সভ্যতার এ ব্যস্ত সময়ে আজকের শিশুদের শৈশবকে নষ্ট করছে শিক্ষার অব্যবস্থাপনা। আমাদের দেশের শিশুরা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই একটা অনিরাপদ ও বৈষম্যমূলক পরিবেশের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। নিদেনপক্ষে বর্তমান যুগের একক পরিবারগুলোতেও শিশুবান্ধব পরিবেশের এক বেহাল দশা পরিলক্ষিত হয়! কেবলমাত্র অভাবগ্রস্ত প্রান্তিক শিশুরাই নয় বরং অট্টালিকার চার দেয়ালের মাঝে বন্দি শিবিরে বেড়ে ওঠা অভিজাত শিশুদের আক্ষেপের কথাগুলো শুনলে অনেক বেশি শিহরিত হতে হয়। কাগজে-কলমে ‘শিশু-সুরক্ষা’ আর ‘শিশু অধিকারের’ স্লোগান শুনে শিশুরা আজ বড্ড ক্লান্ত। আধুনিক মা-বাবাদের বাড়াবাড়ি আচরণে আজ তারা বেজায় বাকরুদ্ধ। 
অভিভাবকগণ আধুনিক জীবনে যে মনোবাসনা পূরণ করতে পারেনি, সন্তানদের দ্বারা সেটি বাস্তবায়নের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন দলবেঁধে। প্রতিটি পরীক্ষার ফলাফল ভালো না হলে যেন অভিভাবকত্বের মানহানি ঘটে। মুক্ত চিন্তা, উন্মুক্ত আলোবাতাস, দামাল ছেলে-মেয়েদের ঐক্য, বাংলার মাটির সোঁদা গন্ধ, বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা, সামাজিক আচার, পারিবারিক বন্ধন, এমনকি পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা সম্পর্কে এ যুগের ‘এ’ প্লাস প্রাপ্ত শিশুরা খুব বেশি অবগত নয়। বাপ-দাদার যুগে মানুষ গরু-ছাগল লালন-পালন করেছে। তাই নবাগত শিশুদের ডলফিন-ডাইনোসোরকে আবিষ্কার করতে শেখানো হয়। গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে, ঝি-ঝি পোকার শব্দ শোনার কাক্সিক্ষত অভিলাস তাই অপূর্ণই থেকে যায় তাদের কাছে। বাড়ির দুয়ারে আম-জাম-লিচু গাছতলায় কিশোর-কিশোরীদের স্বাধীনভাবে চলার-বলার-খেলার কোনো অধিকারই তাদের থাকে না। শিক্ষিত মা-বাবাদের একটাই লক্ষ্য- ‘ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে, মন না চাইলেও পড়তে হবে, পড়তে হবে, পড়তে হবে, হবেই ..., ভালো রেজাল্ট করতে হবে, করতে হবে, করতে হবে, হবেই..., মা-বাবা দুজনেই যখন উচ্চশিক্ষিত তবে তো তাদের আরও উচ্চ কোনো শিখরে পৌঁছাতে হবে, পৌঁছাতে হবে, হবেই...!
একবিংশ শতাব্দীর রজতজয়ন্তীর ক্রান্তিবেলায় আমাদের শৈশবকালীন স্মৃতিগুলো নিবিড়ভাবে টানছে। আর তাই চোখের সামনেই শিশু-নির্যাতন তথা শিশুর প্রতি অবিচার/ অত্যাচারের ঘটনাগুলো দেখে বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছি। শিক্ষার মান উন্নয়নের নামে যেন অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন আজ শিক্ষক নামক জাতির বিবেকগণ। নীতি-প্রণেতাগণ চুপটি মেরে থাকবেন কেন...? তারা তো প্রতি বছরই সিলেবাস পরিবর্তন করেই চলেছেন। কোচিং বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন। কালে-ভদ্রে বিদ্যালয় তথা শিক্ষাব্যবস্থা পরিদর্শন করছেন। শ্রেণিকক্ষে ডিজিটাল সামগ্রী অনুদান দিচ্ছেন। আরও কত কি....! পক্ষান্তরে, প্রাইভেট/ পাবলিক (সরকারি নয় এমন) শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতি বছর, কখনো আবার দু’বারও বেতন বৃদ্ধি করছেন। একই শিক্ষক বিদ্যালয়ে সাধারণ মানের শিক্ষাদান করেন। তারাই আবার প্রাইভেটে কিংবা কোচিং বাণিজ্যে অসাধারণ বণিক বনে যান। সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষকের যশ-খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই...। অতএব, এবার কোচিং বাণিজ্যে খদ্দের না হয়ে কি উপায় আছে...? কোচিং বিপণনের চাহিদা এতটাই তুঙ্গে যে, আগে এলে আগে আসন বরাদ্দ পাবে, নয়ত...এই বুঝি শিক্ষার্থী পিছিয়ে গেল অসুস্থ প্রতিযোগিতায়।
সরকারি তৎপরতায় ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ সমূহে ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন- অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সরকারি সহায়তা ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হচ্ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমে যাচ্ছে। তাহলে সরকারের এই পদক্ষেপসমূহ কাদের জন্য? পক্ষান্তরে, শহুরে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহে উপচে পড়া ভিড়। দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চতুর্গুণ টাকার বিনিময়ে এমনকি আনলিমিটেড ঘুষের বিনিময়ে হলেও ভর্তি করানো চাই-ই, চাই। এসব লজ্জার প্রতিচ্ছবি দেখবার কি কেউই নেই?
শৈশবে আমরা যখন স্কুল কামাতাম, প্রিয় শিক্ষকগণ খোঁজ নিতে বাড়িতে পর্যন্ত আসতেন। শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকগণকে আহ্বান করতেন। আমরা কালেভদ্রে পরিপাটি হয়ে স্কুলে যেতাম, বেশিরভাগ সময়ই স্কুল পালিয়ে শৈশব উপভোগ করতাম। বড়দের সম্মান করতাম, হা-ডু-ডু খেলতাম, খালে-বিলে মাছ ধরতাম। শাপলা ফুলের মালা গেঁথে দল বেঁধে বাড়ি ফিরতাম। মা-বাবার বকুনি (কখনো কান মলানো) খাবার ভয়ে বিড়াল পায়ে দাদা-দাদির ঘরে আশ্রয় নিতাম। বিকেল বেলা আবারও সেই মিলনমেলা। ছায়া-ঢাকা গাঁয়ে বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি তখনো। তার পরেও সামাজিক মূল্যবোধের চর্চার ফলে অতিসাধারণ শিক্ষার্থীর মনে একটা অলৌকিক আলোকছটা বিরাজ করতো। আর বর্তমানে শিশুর শৈশবকে সুকৌশলে নষ্ট করা হচ্ছে। কখনো শিক্ষার মানোন্নয়নের দোহাই দিয়ে শিশুর প্রতি অমানুষিক চাপ প্রযোগের মাধ্যমে। কখনো আবার সন্তানের উন্নত রেজাল্টের স্বপ্নে বিভোর হয়ে মা-বাবার শহরে পাড়ি জমানোর মাধ্যমে। একই সঙ্গে যৌথ পরিবারের সান্নিধ্য  থেকে সন্তানদের বঞ্চিত করার মাধ্যমে।
এখনকার শিশুরা রোজ স্কুলে যায়, বেশিরভাগ স্কুল শুরু হয় ৭.৩০ মিনিটে। কিন্তু উপস্থিত হতে হয় ৭.১৫ মিনিটের আগে । কোন এক স্কুলের নিয়ম- ‘কোনো কারণে (যানজট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসুস্থতা অথবা অন্য কোনো অনিবার্য কারণে) ৭.১৬ মিনিট বাজলে সেই শিক্ষার্থীকে আর স্কুলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। দাঁড়োয়ানকে অনুরোধ করলেও কোনো লাভ হয় না। বরং কর্তৃপক্ষের নির্দেশানুযায়ী শিক্ষার্থীসহ অভিভাবককে দুর-দুর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। নামি-দামি স্কুল বলে কথা। এটাই বুঝি শৃঙ্খলা আর শিষ্টাচার শেখানোর কৌশল। সম্প্রতি, জনৈক অভিভাবকের ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়াতে সন্তানসহ তাঁকে দাঁড়োয়ান তাড়িয়ে দেয়। মাত্র ৬ বছরের শিক্ষার্থীরা ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও রোজ ভোর ৬ টায় উঠে, ড্রেস-আপ করে রোজ স্কুলে যায়। নয়তো জরিমানা গুনতে হবে ও পরীক্ষায় নম্বর কম পাবে। ১১ টায় ফেরে আবার ড্রেস চেঞ্জ করে কিছু খায় অথবা খেতে ইচ্ছেও করে না তাতে কারও কিচ্ছু এসে যায় না। এবার অন্য আরেকটি স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হয়। যেহেতু সরকার কোচিংবাণিজ্য বন্ধের ঘোষণা করেছে তাই কর্তৃপক্ষ স্কুল নামে বহাল তবিয়তে কোচিংবাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। সুবোধ শিক্ষার্থীদের স্কুল নামক কোচিং সেন্টারে ড্রেস গায়ে যেতে হয়। শিক্ষা অমূল্য ধন বলেই নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের দুপুর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্র সেজে যেতে হয়। মা-বাবার বাড়াবাড়ির কারণে বাড়িতে ফিরেই আবারও অধ্যয়নের প্রস্তুতি নিতে হয় তাদের। ক্ষুধার চেয়ে ঘুম যখন বেশি প্রয়োজন তখন তাদের জোর করে হলেও অভিভাবকের নির্দেশে খেতে বাধ্য হতে হয়। এভাবেই চলতে থাকে সুন্দর শৈশব কেড়ে নেওয়া হাজারো কোমলমতি শিক্ষার্থীর প্রতিদিন। 
এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেশের আনাচে কানাচে এখন নতুন কিছু নয়। অথচ অদৃশ্য কারণে যথাযথ কর্তৃপক্ষ নির্বাক কেন? আমরা প্রত্যেকেই মুখে বলি ‘শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ’। অথচ সুকৌশলে তাদের বর্তমানের ও অতীতের শৈশবকে আমরা প্রতিদিন নষ্ট করছি। সম্প্রতি ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী ধ্রুব জিৎ কর্মকার (২২) পড়ালেখার অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে না পেরে স্বেচ্ছায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমায়। পক্ষান্তরে মা-বাবাসহ এদেশের শিক্ষার ব্যবস্থার প্রতিরাগ-ক্ষোভ-অভিমান-চাপা কষ্টও নয় কি? এভাবেই ধ্রুব জিৎ কর্মকারের মতো লাখো শিক্ষার্থীর প্রতিদিন অকাল মৃত্যু ঘটে, যা হয়তো বিবেকবর্জিত সমাজকে স্পর্শ করতে পারে না। অনেক শিক্ষার্থী এভাবেই জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকে মানুষরুপী শিক্ষিত সমাজের বেষ্টনীতে।
শিশুর আর্তনাদ শোনার জন্য কেউ কি আছেন...? তবে জেগে উঠুন সর্বাগ্রে তাদের মিছিলে। তাদের ‘মানুষ’ হিসেবে বাঁচতে দিন। তাদের বর্ণিল শৈশব কেড়ে নিয়ে আমরা কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনই করছি না বরং বিবেক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঠেলে দিচ্ছি। শিক্ষার সার্বিক অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এভাবেই শিশুর শৈশবকে নষ্ট করা বন্ধ হোক। এক্ষেত্রে সকলের সচেতনতা কাম্য।

লেখক : উন্নয়নকর্মী

প্যানেল

×