ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৪ জুন ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঘূর্ণিঝড় আসে কোথা থেকে? কেনই বা বারবার বাংলাদেশে?

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ৩ জুন ২০২৫

ঘূর্ণিঝড় আসে কোথা থেকে? কেনই বা বারবার বাংলাদেশে?

ছবি: সংগৃহীত

ঘূর্ণিঝড় হলো উষ্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট এক ধরনের তীব্র বায়ুমণ্ডলীয় আলোড়ন, যার বিধ্বংসী ক্ষমতা রয়েছে। এটি তৈরি হয় কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক কারণে।

প্রথমত, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে জলীয় বাষ্প উপরে উঠে মেঘ তৈরি করে, যা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টিতে সহায়তা করে। দ্বিতীয়ত, পর্যাপ্ত আদ্রতা বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের যোগান দেয়, যা ঘূর্ণিঝড় গঠনের জন্য অত্যাবশ্যক। তৃতীয়ত, সমুদ্রপৃষ্ঠে উষ্ণতার কারণে হালকা বাতাস উপরে উঠে গিয়ে একটি নিম্নচাপ অঞ্চলের সৃষ্টি করে। এই নিম্নচাপই ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র।

চতুর্থত, পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট করিওলিস প্রভাব ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণনে সহায়তা করে। উত্তর গোলার্ধে ঘূর্ণিঝড় ঘড়ির কাটার বিপরীতে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরে। বিষুবরেখার কাছাকাছি করিওলিস প্রভাব দুর্বল হওয়ায় সেখানে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় না। পঞ্চমত, বায়ুমণ্ডলে উলম্ব বায়ুপ্রবাহের অনুপস্থিতি বা দুর্বলতা ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।

এইভাবে ঘূর্ণিঝড় একটি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় শক্তি সঞ্চয় করে—উষ্ণ জলীয় বাষ্প উপরে উঠে ঠান্ডা হয়ে ঘন হয়ে মেঘ তৈরি করে, যার ফলে সুপ্ত তাপ নির্গত হয়ে আশপাশের বাতাসকে আরও উষ্ণ করে তোলে এবং আরও উপরে উঠতে সহায়তা করে। এতে করে বাতাসের নিচ ও উপরমুখী প্রবাহের একটি ঘূর্ণন শুরু হয়, যার ফলে ঘূর্ণিঝড় ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর কেন্দ্রে তৈরি হয় একটি শান্ত ‘চোখ’, যার চারপাশে তীব্র বায়ুপ্রবাহ, বজ্রপাত ও ভারী বৃষ্টিপাত ঘটে।

অতীতে বাংলাদেশের উপর আঘাত হানা বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলো
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রতিবছরই উপকূলীয় এলাকাগুলো ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকে। অতীতে বেশ কয়েকটি বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় দেশজুড়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে:

১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়: বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। এতে প্রায় ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার।

১৯৯১ সালের চট্টগ্রাম ঘূর্ণিঝড়: এতে প্রাণ হারান প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ। বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৪০ কিমি।

২০০৭ সালের সিডর: সুন্দরবন ও উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়, ৩৪০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে। বাতাসের গতি ছিল ২৪০ কিমি প্রতি ঘণ্টা।

২০০৯ সালের আইলা: সুন্দরবন ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা সৃষ্টি করে।

২০১৩ সালের মহাসেন: দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হেনে ব্যাপক ক্ষতি ঘটায়।

২০২০ সালের আমফান: একটি সুপার সাইক্লোন হিসেবে উপকূলে আঘাত হানে। প্রস্তুতির কারণে প্রাণহানি কম হলেও, ক্ষয়ক্ষতি ছিল ব্যাপক।

চলতি বছরের আশঙ্কা
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ও বঙ্গোপসাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে চলতি বছর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে। এল নিনো ও লা নিনার মতো বৈশ্বিক আবহাওয়া প্যাটার্নের প্রভাবও এই প্রবণতা বাড়িয়ে দিতে পারে।

সাধারণত প্রতিবছর ২ থেকে ৪টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলের কাছাকাছি আসে, যার মধ্যে ১ বা ২টি সরাসরি আঘাত হানে। তবে এবার আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করছেন, বঙ্গোপসাগরে ৩ থেকে ৫টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হতে পারে, যার মধ্যে ২ বা ৩টি সরাসরি বাংলাদেশে আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত একটি ঘূর্ণিঝড় তীব্র হতে পারে বলেও সতর্কতা দেওয়া হচ্ছে। তবে শেষ মুহূর্তে বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্রের পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে ঘূর্ণিঝড়ের গতি ও তীব্রতা নির্ধারিত হয়।

করণীয়
ঘূর্ণিঝড় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও সচেতনতা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। উপকূলবর্তী জনগণকে সচেতন করা, আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা জরুরি। সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও সতর্ক থাকতে হবে এবং আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস মেনে চলতে হবে।

ফরিদ

×