
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা আত্মিক উন্নয়নের পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব পালনে স্পষ্ট ও সমন্বিত দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এই মহান ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি হলো হজ। আর হজের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে আসে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। তাছাড়া, ঈদুল আজহা মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি, যা আত্মত্যাগ, আনুগত্য, তাকওয়া ও মানবিকতার অনন্য বার্তা বহন করে। এই ঈদের মূল শিক্ষা ও প্রেরণা এসেছে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর নিঃস্বার্থ আজ্ঞাপালন ও ত্যাগের ঘটনা থেকে। এই ঈদ ব্যক্তিকে আত্মশুদ্ধি, আনুগত্য ও তাকওয়ার শিক্ষা দেয়, পরিবারে ভালোবাসা ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি করে, সমাজে দানশীলতা ও সহানুভূতির বার্তা পৌঁছায় এবং রাষ্ট্রে দায়িত্ববোধ ও শৃঙ্খলা গড়ে তুলে মানবিক ও ন্যায্য সমাজ গঠনে সাহায্য করে। তাই, কোরবানির ঈদের তাৎপর্য জীবনের প্রতিটি স্তরে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে এবং আমাদের সামগ্রিক জীবনের সাফল্য ও উন্নয়নের পথে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে।
এই ঈদের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে সেই ঐতিহাসিক ত্যাগের ঘটনার দিকে, যেখানে হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে নিজের প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি দিতে প্রস্তুত হন। মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এই ঘটনার বর্ণনা করেছেন: ‘অতঃপর যখন সে (ইসমাঈল) তার পিতার সাথে চলাফেরা করার উপযোগী হলো, তখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে কোরবানি করছি, তুমি কী বল? সে বলল, হে পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা করুন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজন পাবেন।‘ (সূরা আস-সাফফাত, ১০২)। এই আত্মত্যাগের প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহ ইব্রাহিম (আ.)-এর সেই আমল কবুল করে নেন এবং তার (পুত্র) স্থলে একটি জান্নাতি পশু কোরবানি করার ব্যবস্থা করেন।
মহান আল্লাহর প্রতি হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগ আমাদের এ শিক্ষা দেয় যে, জীবনে মহান উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কখনো কখনো প্রিয়তম জিনিসকেও ত্যাগ করতে হয়। পাশাপাশি, আমাদের নিজের অন্তরের লোভ, অহংকার, হিংসা ও হীনম্মন্যতা পরিহার করে আত্মিক পরিশুদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু বর্তমান সমাজের চিত্রটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমরা এক নির্মম বাস্তবতায় আজ নিমজ্জিত। যেখানে লোভ, অহংকার, হিংসা ও হীনম্মন্যতা যেন আমাদের স্বভাবগত আচরণে পরিণত হয়েছে। চারপাশে কেবল নিজের প্রয়োজন, নিজের সুবিধা, নিজের সফলতা নিয়েই এক অস্থির প্রতিযোগিতা। এই আত্মমগ্নতার মধ্যে দেশ, সমাজ বা জাতির বৃহত্তর কল্যাণ নিয়ে ভাবার মতো সময় বা মনোযোগ আমাদের অনেকেরই নেই, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হতাশাজনক।
তাই আত্মিক পরিশুদ্ধির এই পথে আমাদের প্রয়োজন ইব্রাহিম (আ.)-এর মতো নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি নির্ভেজাল আনুগত্য, যা কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং সামষ্টিকভাবে সমাজকেও শুদ্ধির পথে নিয়ে যেতে পারে। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ পাওয়ার পর কোনো প্রশ্ন করেননি, দ্বিধা করেননি, এমনকি এক মুহূর্তের জন্যও দেরি করেননি। ঠিক তেমনি, আমাদেরও উচিত আল্লাহর নির্দেশ ও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও আপোসহীন আনুগত্য প্রকাশ করা। কেননা, প্রকৃত ঈমানের পরিচয় হলো আল্লাহর আদেশের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য। এই নিঃশর্ত আনুগত্য শুধু ব্যক্তির আত্মিক জীবনকে উন্নত করে না, বরং সমাজের মধ্যে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন মানুষ আল্লাহর নির্দেশ মেনে জীবন পরিচালনা করে, তখন তারা নিজের মধ্যে দয়া, সততা ও ন্যায়বিচার গড়ে তোলে, যা সামাজিক সম্প্রীতি ও ঐক্যের ভিত্তি রচনা করে। ফলে ব্যক্তিগত উন্নতি থেকে শুরু করে সামাজিক কল্যাণ ও সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা সমগ্র জাতির মঙ্গলে পরিণত হয়।
কিন্তু আমরা অনেক সময় সুবিধাবাদী চিন্তা করে ধর্মীয় দায়িত্ব এড়িয়ে চলি। আজকের সমাজে কোরবানির সময় এলেই আমরা এমন কিছু চিত্র দেখতে পাই, যা আল্লাহ্র কোরবানির আনুগত্যের শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অনেক বিক্রেতা পশুকে আর্থিক লাভের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তাকে কৃত্রিমভাবে মোটা-তাজা ও আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ আবার পশুর শরীরে ঘন ঘন পানি ঢেলে বা ক্ষতিকর ওষুধ প্রয়োগ করে পশুর আকৃতি বদলে ফেলেন। উদ্দেশ্য একটাইÑউচ্চ মূল্যে বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জন করা। অথচ এভাবে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা শুধুই একজন নিরীহ মানুষকে ঠকানো নয়, বরং এটি আল্লাহর নির্দেশ ও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞার শামিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছেনÑ যে প্রতারণা করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।‘ (সহীহ মুসলিম, ১০২)।
একইভাবে, বাহ্যিক প্রদর্শন বা লোক দেখানোর প্রবণতাও কোরবানির আত্মত্যাগ, তাকওয়া ও আনুগত্যের শিক্ষা থেকে আমাদের বিচ্যুত করে দিচ্ছে। আল্লাহ তা’আলা কোরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেনÑ ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছে না সেই পশুর মাংস ও রক্ত, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।‘ (সূরা হজ, ৩৭)। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে কোরবানির এই গভীর আত্মিক দিক অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। কোরবানি এখন অনেকের কাছে এক ধরনের সামাজিক প্রতিযোগিতা, স্ট্যাটাস প্রদর্শনের মাধ্যম ও উৎসবধর্মী প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। এই মানসিকতা ইসলামের মূল চেতনাবিরুদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) একে বলেছেন ‘রিয়া’ বা লোক দেখানো আমল, যা ছোট শিরক হিসেবে বিবেচিত হয়।‘ (মুসনাদে আহমদ, ২৩৬৩০)। তিনি আরও বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমল নির্ভর করে নিয়তের ওপর।’ (সহিহ বুখারি, ১)। অর্থাৎ আপনি যদি কোরবানি করেন শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তাহলে সেটি ইবাদত। কিন্তু যদি উদ্দেশ্য হয় মানুষকে দেখানো, তবে সেই কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হয় না। এই লোক দেখানো কোরবানি শুধু আমলই নষ্ট করে না, বরং সমাজে বিভক্তি, হিংসা, প্রতিযোগিতা ও অহংকারকে উসকে দেয়।
তাছাড়া, ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় বিনয়, সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের। মহান আল্লাহ বলেন ‘অহংকারের বশবর্তী হয়ে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কর না, আর পৃথিবীতে গর্বভরে চলাফেরা কর না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা লুকমান, আয়াত ১৮)। কোরবানির ক্ষেত্রেও এই আদর্শ প্রযোজ্য। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় আমরা দেখি, কেউ কেউ একাধিক গরু কোরবানি করে তা নিয়ে অহংকার করেন। প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের তুলনায় বড় বা দামি পশু কিনে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। আরও দুঃখজনক হলো, এই অতিরিক্ত প্রদর্শন অনেক সময় আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষের হৃদয়ে বেদনার সৃষ্টি করে। শিশুদের মাঝেও এক ধরনের প্রতিযোগিতার জন্ম নেয়Ñ কে কত বড় গরু এনেছে। এই ধরনের তুলনামূলক মানসিকতা ঈদের আনন্দ ও কোরবানির শিক্ষাকে ক্ষুণ্ন করে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, কোরবানির ঈদ কেবল উৎসবের দিন নয়, এটি ত্যাগ, আনুগত্য, তাকওয়া ও মানবিকতার শিক্ষা বহন করে। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আল্লাহর নির্দেশের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যই ঈমানের প্রকৃত পরিচয়। আমরা যেন ভুলে না যাই, আল্লাহর কাছে পশুর মাংস বা রক্ত নয়, গ্রহণযোগ্য হয় কেবল আমাদের তাকওয়া ও নিয়ত। তাই আমাদের উচিত হবে কোরবানিকে শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকওয়া, বিনয় ও সহমর্মিতার অনুশীলনের একটি শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা। তাহলেই কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল হবে এবং আমরা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রজুড়ে একটি শান্তিপূর্ণ ও মানবিক পরিবেশ গড়ে তুলতে পারব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
প্যানেল