ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

চামড়ার বাজার কি পাবে এবার ন্যায্য দাম?

নুসরাত জাহান অর্পিতা

প্রকাশিত: ২০:২০, ১ জুন ২০২৫

চামড়ার বাজার কি পাবে এবার ন্যায্য দাম?

ঈদুল আজহা আমাদের কাছে শুধু আনন্দের উৎসব নয়, বরং এটি ত্যাগ ও সহমর্মিতার এক মহান বার্তা বহন করে। আমরা কোরবানি করি আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায়, আর সেই কোরবানির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পশুর চামড়া। ইসলাম ধর্মে এটি সদকার অংশ হিসেবে বিবেচিত হলেও বাস্তবে চামড়ার এই সদকা অনেক সময় অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার শিকার হয়।
প্রতি বছর ঈদের পর প্রায় একই চিত্র চামড়া রাস্তায় পড়ে থাকে, কখনো মাটিচাপা, কখনো নষ্ট হয়ে যায় অযত্নে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়ে যান, আর বাজার চলে যায় একদল প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের হাতে। সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রির কথা বলা হলেও বাস্তবে সেই দাম পাওয়া দুরূহ। অনেক সময় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা স্থানীয় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে ঠকেন দাম কম পায়, কখনো হুমকি বা বঞ্চনার শিকার হন। এতে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, প্রশ্ন ওঠে আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতা নিয়েও।
কোরবানির চামড়া শুধু একটি অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, এটি একটি ধর্মীয় ও মানবিক দায়িত্বও বটে। যখন কোনো মাদ্রাসা বা এতিমখানা চামড়া পায়, তারা সেটি বিক্রি করে তাদের খরচ চালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বাজারে ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে তারা সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়। চামড়ার এই অপচয় কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, এটি আমাদের মানবিক মূল্যবোধেরও এক বড় প্রশ্নচিহ্ন।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ঈদুল আজহায় বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয়, যা মূলত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়ার। এটি একটি অপার সম্ভাবনাময় সম্পদ, যার যথাযথ ব্যবস্থাপনা হলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখা সম্ভব। দেশের চামড়া শিল্প বহুদিন ধরেই রপ্তানি আয়ের অন্যতম খাত। এই শিল্প থেকে উৎপাদিত হয় জুতা, ব্যাগ, জ্যাকেট, বেল্ট ও আসবাবপত্রের মতো উচ্চমূল্যের পণ্য, যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হয়।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই শিল্পের পেছনে নেই পর্যাপ্ত অবকাঠামো, নেই পরিকল্পিত নীতিমালা। এর ফলে প্রতি বছর ঈদের মৌসুমে কাঁচা চামড়ার প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ ও বিতরণে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। একদিকে কাঁচা চামড়ার দাম পড়ে যায়, অন্যদিকে চামড়াজাত পণ্যের দাম থাকে আকাশচুম্বী। এই বৈষম্য প্রমাণ করে, সমস্যাটা শুধু বাজার নয় মূল সমস্যা আমাদের অব্যবস্থা, অবহেলা এবং দীর্ঘমেয়াদি অবনমন।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে গঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আসন্ন ঈদুল আজহার আগে কাঁচা চামড়ার এই সংকট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে, যা নতুন করে আশার আলো জাগিয়েছে। তবে এই উদ্যোগের সফলতা নির্ভর করছে দ্রুত বাস্তবায়ন, কঠোর তদারকি, স্বচ্ছ নীতি প্রণয়ন ও সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারের সমন্বিত সহযোগিতার উপর। প্রতি বছর ঈদুল আজহায় যেভাবে একই ধরনের সংকটের পুনরাবৃত্তি ঘটে, তা থেকে উত্তরণে এবারকার উদ্যোগ যেন না হয় কেবল কাগুজে পরিকল্পনা।
চামড়া শিল্পের এই সংকট কেবল একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি আমাদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতিও এক বড় প্রশ্নচিহ্ন। প্রতি বছর কোরবানির চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, এবং অব্যবস্থাপনা - এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসাটা জরুরি। সরকার কর্তৃক গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক, তবে এর সফলতা নির্ভর করবে দ্রুত বাস্তবায়ন, কঠোর তদারকি এবং স্বচ্ছ নীতি প্রণয়নের ওপর। একই সঙ্গে, নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কোরবানির প্রকৃত বার্তা-ত্যাগ ও সহমর্মিতা-সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। চামড়া শিল্পকে একটি শক্তিশালী এবং টেকসই খাতে পরিণত করতে হলে কেবল দামে হস্তক্ষেপ নয়, বরং পুরো ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানো এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তাহলেই কোরবানির চামড়া আর অবহেলার শিকার হবে না, বরং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×