
বাংলাদেশে নার্সিং শিক্ষা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অথচ অবহেলিত খাত বলা যায়। একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কার্যকর ও মানবিক করার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পাশাপাশি দক্ষ নার্সের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, এদেশে নার্সিং শিক্ষা যেন অবহেলার চাদরে ঢাকা একটি অচর্চিত অধ্যায়। এই অবহেলার দায় কার- রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার নাকি নিজেদের? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের সামনে আসে একটি সমষ্টিগত ব্যর্থতার চিত্র।
সরকারি পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে নার্সিং শিক্ষা এখনো এক প্রান্তিক খাত হিসেবে রয়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দের একটি বড় অংশ চিকিৎসকদের উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ কিংবা ওষুধ সরবরাহে ব্যয় হলেও নার্সিং শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে তেমন কোনো বড় উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। অনেক সরকারি নার্সিং কলেজেই নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক, প্র্যাকটিক্যাল ল্যাব, অথবা মানসম্মত পাঠ্যক্রম। একটি উন্নত প্রশিক্ষণ ছাড়া নার্সদের কাছ থেকে পেশাদার সেবা আশা করাটা যেমন অযৌক্তিক, তেমনি দায়সারা প্রশিক্ষণের ফলে স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। এমনকি নার্সদের উচ্চশিক্ষার সুযোগও সীমিত। মাস্টার্স বা পিএইচডি পর্যায়ে নার্সিংয়ে বিশেষায়িত পড়াশোনা করতে অনেককে দেশের বাইরে যেতে হয়, যা সবার জন্য সম্ভব হয় না।
এদিকে সমাজেও নার্সিং পেশাকে ঘিরে রয়েছে এক ধরনের অবমূল্যায়ন। বহু পরিবারে এখনো নার্সিংকে মেয়েদের জন্য ‘সাধারণ’ পেশা হিসেবে ধরা হয়, যেখানে পুরুষদের অংশগ্রহণ প্রায় অপ্রতুল। একটি পেশা যদি লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আবদ্ধ থাকে, তবে সেটির সার্বিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। তাছাড়া ‘ডাক্তার না হতে পারলে নার্স’ এই চর্চিত কটাক্ষ সমাজে নার্সিংয়ের প্রতি একধরনের অবজ্ঞা তৈরি করেছে, যা অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে এই পেশা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নার্সিং একটি উচ্চমর্যাদার ও গবেষণামূলক পেশা, যেখানে দক্ষতা, মানবিকতা ও নেতৃত্বগুণ একত্রে বিকশিত হয়।
দেশের প্রধান প্রধান পত্রিকা এবং টেলিভিশনে চিকিৎসক সংকট, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা কিংবা হাসপাতাল অব্যবস্থাপনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও নার্সদের সমস্যা, নার্সিং শিক্ষার দুরবস্থা, পেশাগত চ্যালেঞ্জ বা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। এই নিরবতা আসলে এক ধরনের অনুমোদনযোগ্য অবজ্ঞা, যা সামাজিক চেতনায় নার্সিংয়ের গুরুত্বকে আরও ক্ষীণ করে দেয়। মিডিয়ার মূলধারায় নার্সদের সাফল্য, উদ্ভাবন বা সংগ্রাম উঠে আসলে হয়তো এই পেশার প্রতি নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাত।
অন্যদিকে নার্সিং পেশার সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যক্তিও নিজেদের অধিকার আদায়ে যথেষ্ট সক্রিয় নন। অনেকেই দাপ্তরিক সীমাবদ্ধতা বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির চাপে নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। পেশাগত সংগঠনগুলোরও মাঝে মাঝে একতা ও কার্যকারিতার অভাব দেখা যায়। একটি পেশাকে মর্যাদার জায়গায় নিতে হলে এর সঙ্গে যুক্ত মানুষদের নেতৃত্ব, দাবিদাওয়া, পেশাদারিত্ব এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের নার্সরা অনেকটাই নিরুৎসাহিত ও দুর্বল ভূমিকা পালন করছেন, যা তাদের প্রতি সমাজের দীর্ঘদিনের অবহেলার একটি প্রভাবমাত্র।
নার্সিংয়ের প্রতি এই অবহেলা শুধু একটি পেশাকে ছোট করে দেখা নয় এটি গোটা জাতির স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলার নামান্তর। করোনাকালীন সারা বিশ্বের মানুষ বুঝেছেন, চিকিৎসক ও নার্স- উভয়ের সহযোগিতা ছাড়া একটি কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা সম্ভব নয়। অথচ আমরা আজও নার্সদের যথাযথ মর্যাদা দিতে ব্যর্থ। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দরকার একটি সম্মিলিত আন্দোলন রাষ্ট্রীয় নীতির সংশোধন, নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিকীকরণ, প্রশিক্ষকদের মানোন্নয়ন, উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ, নার্সদের জন্য গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন এবং আন্তর্জাতিক মানের পাঠ্যক্রম চালু করার মতো সময়োপযোগী পদক্ষেপ। একই সঙ্গে দরকার সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা, এবং পেশাগত সংগঠনগুলোর শক্তিশালী কার্যক্রম। নার্সিং শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নের অংশ হিসেবে ভাবতে হবে, নয়তো এই খাতটি চিরকালই পেছনে পড়ে থাকবে। সুতরাং, নার্সিং শিক্ষার প্রতি অবহেলার দায় শুধু একপক্ষের নয় এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের একযোগে কাজ করতে হবে এই পরিস্থিতি বদলাতে। আমরা যদি সত্যিই একটি মানবিক ও উন্নত বাংলাদেশ চাই, তবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভকে আর অবহেলার সুযোগ নেই।
প্যানেল