
ছবি: সংগৃহীত
“ভালোবাসা যদি পাখির মতো উড়ে আসে, তাহলে কি নিশ্চিত তুমি তাকে খাঁচায় বন্দি রাখতে পারবে?”
—এক প্রেমহত তরুণের ডায়েরির পাতা
একসময় প্রেম ছিল কবির চোখে মহাজাগতিক আলোকরেখা। সময়ের সাথে সাথে সেই প্রেম আজ হয়ে উঠেছে তরুণ সমাজের অন্ধ আবেগের এক অনিয়ন্ত্রিত জোয়ার। যেখানে হৃদয়ের টান জয়ের আগেই নিয়ে আসে দায়িত্বহীনতার বোঝা, আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, আর এক অনির্বচনীয় হাহাকার।
★ আবেগ যখন অন্ধ বিনিয়োগ
ভাবুন, আপনি একটি ব্যবসায় সময়, মনোযোগ, আবেগ এমনকি সম্ভাবনা বিনিয়োগ করলেন। কিন্তু বিনিময়ে ফিরল হতাশা, অনুশোচনা ও অপূরণীয় ক্ষয়। আজকের দিনে প্রেম অনেকটা সে রকমই—একটি নিম্ন রিটার্ন বিনিয়োগ, যেখানে লাভের আশা থেকে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।
২০১৬ সালে CDC-এর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন প্রায় ৪,২৭৯ জন তরুণ। ২০২১ সালে, Indian Express-এর প্রতিবেদনে উঠে আসে ১৮ বছরের নিচে আত্মহত্যার ঘটনা ৩৯৫টি, যার পেছনে প্রধান কারণ ছিল সম্পর্কভাঙনের যন্ত্রণা।
এই সংখ্যাগুলো নিছক পরিসংখ্যান নয়—এগুলো হাজারো তরুণ-তরুণীর ভেঙে পড়া জীবনের একেকটি নিষ্ঠুর চিহ্ন।
★ প্রেমের মাদকতা: যখন হৃদয় বন্দী হয় হরমোনে
নিউরোসার্জন ড. রাহুল জানদিয়ালের গবেষণা বলছে, প্রথম প্রেমে পড়ার সময় মস্তিষ্কে নিঃসৃত হয় ডোপামিন ও সেরোটোনিন, যা কোকেন গ্রহণকারী মাদকাসক্ত ব্যক্তির অনুভূতির সঙ্গে তুলনীয়।
তাই প্রেম যখন ভাঙে, তখন তা শুধু হৃদয় নয়, পুরো স্নায়ুতন্ত্রেই আঘাত হানে। একজন মানুষ বিষণ্নতায় ভোগেন, আত্মবিশ্বাস হারান এবং কখনো কখনো বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এটি আর কেবল আবেগের গল্প নয়, এটি মনোবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও এক ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া।
★ সম্পর্কের আয়ু ফুরায়, স্বপ্নের মৃত্যু হয়
ষাটের দশকে প্রেম থেকে বিয়েতে গড়ানোর হার ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। নব্বইয়ের দশকে তা কমে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। ২০২৩ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাত্র ২৪ শতাংশ প্রেমই বিয়েতে পরিণত হয়। অর্থাৎ প্রতি চারজনে মাত্র একজন তার ভালোবাসাকে বিয়ের বন্ধনে বাঁধতে পারে।
বাকি সবাই একসময় হয়ে ওঠে ‘এক্স’—স্মৃতির বোঝা বইতে থাকা মানুষ। এই হার শুধু সম্পর্কের পরিণতির কথা বলে না, বলে সময়, স্বপ্ন ও মনোবলের অপচয়ের করুণ পরিসংখ্যান।
★ কাঁচা বয়সে পাকা আবেগ: শিক্ষার্থীদের জন্য প্রেম কি বিষফল?
একজন শিক্ষার্থীর জীবনের মূল পুঁজি হলো সময় ও লক্ষ্য। কিন্তু অনেকেই প্রেমে জড়িয়ে পড়ে তখন, যখন নিজের অবস্থানই স্থির হয়নি। ফলে প্রেম হয়ে ওঠে বিভ্রান্তির উৎস, যা তাদের দূরে ঠেলে দেয় পড়াশোনা, ক্যারিয়ার এবং আত্মউন্নয়নের পথ থেকে।
আব্রাহাম মাসলোর “Hierarchy of Needs” তত্ত্ব অনুসারে, ভালোবাসা আসে নিরাপত্তা ও প্রাথমিক চাহিদা পূরণের পর। অথচ আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রেমে পড়ে সেই স্তরে পৌঁছানোর আগেই। ফলাফল—ব্যর্থতা, হতাশা এবং জীবনের প্রতি নেতিবাচক মানসিকতা।
★ সমাজ ও পরিবারের অদৃশ্য দেয়াল
প্রেম হয়তো ব্যক্তিগত, কিন্তু তার পরিণতি সামাজিক। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে প্রেমকে এখনো পরিবার ও সমাজ স্বতঃসিদ্ধভাবে মেনে নেয় না।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ প্রেমঘটিত সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত পরিবার থেকে স্বীকৃতি পায় না। মুম্বাই হাইকোর্টের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, পারিবারিক পছন্দে হওয়া বিয়ের বিচ্ছেদ হার প্রেমের বিয়ের তুলনায় অনেক কম।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে—যে সম্পর্কে সমাজ পাশে দাঁড়ায় না, পরিবার মেনে নেয় না, এবং সময়ের পরীক্ষায় টিকেও না, সেই সম্পর্কে অন্ধ আবেগ দিয়ে ঝাঁপ দেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?
★ ভালোবাসা নয়, আগে গড়ে তুলুন নিজেকে
প্রেম মহৎ, প্রেম অনন্য। কিন্তু সেই প্রেমই ভয়ংকর হয়ে ওঠে যখন তা হয় অপ্রস্তুত, অপরিণত হৃদয়ের খেলা। আত্মপরিচয় না গড়ে, নিজেকে না চিনে প্রেমে পড়া মানে নিজের ভবিষ্যতের দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া।
প্রথম প্রয়োজন নিজের ভিত তৈরি করা—পড়াশোনায় মনোযোগ, দক্ষতা অর্জন, আত্মবিশ্বাস গঠন। তবেই প্রেম হবে আশীর্বাদ, নয়তো তা পরিণত হবে অভিশাপে।
❝যে হৃদয় নিজের শূন্যতা পূরণ করতে পারে না, সে আরেকজনের ভালোবাসাও ধারণ করতে পারে না।❞
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো,মিশর
ফরিদ