
ষড়ঋতুর বিচিত্র লীলাভূমি আবহমান এই বাংলা। ধন-ধান্য-পুষ্প-ভরা শাশ্বত বাংলা অস্ট্র্রিক জাতিগোষ্ঠীর এক পরম নির্মাল্য। সবুজ শস্য শ্যামল বাংলা সমুদ্র পরিবেষ্টিত আর নদীস্নাত এক উর্বর পলিমাটির চারণ ভূমি হিসেবেও স্বীকৃত, নন্দিত। নানামাত্রিক প্রাকৃতিক সম্ভারে হরেক বিপন্নতা ও চিরায়ত নৈসর্গের এক অবধারিত দুর্যোগ। হিত আর বিপরীত যমজ ভাইয়ের মতো এক অভিন্ন হলেও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বিসদৃশ্য চিহ্নিত হতেও সময় লাগে। আমরা এখন পার করছি মধু মাস জ্যৈষ্ঠের এক অবারিত ফলের বহুমাত্রিক আবেদনে। আম, জাম, কাঁঠাল ও লিচুর মধু মিশ্রিত সৌরভ বাংলার প্রাকৃতিক বৈভবের সুমধুর ঐক্যতান। আবার জলসিক্ত বারিধারার প্রাবল্যেও নাজেহাল হওয়ার বিপরীত আবহ দেশটিকে দিয়েছে ঋতুবৈচিত্র্যের বিরূপ পরিবেশের অন্যমাত্রার দুর্ভোগ, ক্লান্তি। গ্রীষ্মকালীন অন্তিম সময়ে বর্ষার দুর্ভোগও কেমন যেন পিছুই হটে না। আর উপকূলীয় অঞ্চলগুলো যে মাত্রায় সংহার আর দুর্যোগ মোকাবিলা করে তাও এই বরেন্দ্র পলিমাটির দুঃসহ পালাক্রম। সেখানে উপকূলীয় মানুষদের ঝড়ো হাওয়া সঙ্গে বর্ষার যে অনিঃশেষ যাতনা তা কিন্তু মাটির উর্বরা শক্তি বাড়িয়ে দেয়। সঙ্গত কারণে উৎপাদনেও আসে অবিমিশ্র আনন্দ ধারা। কবি গুরু তো বলেই দিলেনÑ বীজ মাত্রই নাকি এখানে সোনা ফলে। শুধু যে কাব্যিক মূর্ছনা তা নয় বরং বরেন্দ্র ভূমির চিরায়ত সম্ভারের অনন্য পথযাত্রা তো বটেই। শুধু কি ক্রিয়ায় যাত্রাপথ সুগম আর নিরবচ্ছিন্ন থাকে? মোটেই তা নয়। অনুকূল আর প্রতিকূলের হিত-বিপরীতও যে কি মাত্রায় চেপে বসে তাও অঞ্চলভিত্তিক এক অবিরাম যাত্রাপথ। নিম্নচাপের কারণে শুক্রবারে লাগাতার ভারি বৃষ্টির প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চল জনদুর্ভোগের কবলে পড়ে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপটি তার রুদ্র মূর্তি ধারণ করে উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের বিপদ-বিপত্তির আশঙ্কায় ঘনীভূত হতেও পিছু হটেনি। শুধু কি উপকূলীয় অঞ্চলে তাণ্ডব সৃষ্টি করা? রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাতের ধারায় জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্ভোগ তৈরি করে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়। দেশের বিভিন্ন জেলায় ২ থেকে ৪ ফুট জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কায় সংশ্লিষ্ট জনপদ আর মানুষ পড়ে নির্মম বিপরীত অবস্থার চরম কোপানলে। অবিরাম বর্ষণসিক্ত পরিবেশের পরবর্তী অবস্থা হয় আরও শোচনীয়, দুরবস্থার কবলে। রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যাওয়া, নিম্নাঞ্চলের অতি সাধারণ মানুষের বসতভিটা জলস্রোতে যে বিপন্নতার আকালে পড়ে সেটা সামলাতে উপকূলবাসীকে কত বিপদ আকাল পর করতে হবে তাও নির্দয় পরিস্থিতি চরম ধ্বংসযজ্ঞ। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সামুদ্রিক বন্দরকে ৩ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দেখাতে হয়েছে। গভীর নিম্নচাপটি দেশের সমুদ্র ও নদীবিধৌত অঞ্চল দিয়ে তীব্রভাবে প্রবাহিত হয়ে যে তাণ্ডব চালায় তা পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়েও ঝড়ো হাওয়া আবার বৃষ্টিপাতের চিহ্ন রেখে যায়। বর্তমানে তা দুর্বল হয়েও ক্ষতচিহ্নের যে আঁচড় বসায় তা সামলাতে সংশ্লিষ্ট উপকূলবাসীদের আর কত দুর্ভোগ-দুঃসময় পার করতে হবে তা বলাই বাহুল্য। এমনিতে উপকূলবাসী সারাবছর প্রাকৃতির বিপরীত প্রতিবেশকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করে টিকে থাকে চরম অস্বস্তি আর অনিঃশেষ যাতনায়। নিয়তই লড়াই, সংগ্রামের ইতিবৃত্তে এক জায়গা থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়াও প্রকৃতির দুঃসহ নৃশংসতার ছোবল উপকূলীয়, উপদ্রুত এলাকায় সময় অসময়ের নানামাত্রিক ধ্বংসযজ্ঞের বিপরীত পালাক্রম। আবার চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান আর পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি ঢলে যা হয় তা যেন সমুদ্র আর নদ-নদীর মিলনযজ্ঞে পাহাড়ের উন্মত্ত উন্মাদনা। ভাঙা-গড়ার এমন বিপরীত আর বৈচিত্র্যিক আবহে উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনযাত্রায় যে লাগাতার দুর্ভোগ তাকে সামলাতে গিয়ে যাপিত কর্মযোগের অবর্ণনীয় নৃশংসতাও যেন প্রকৃতি-পরিবেশের লীলাক্ষেত্র। যাতে নিরন্তর মোকাবিলা করতে করতে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী আর পদ যে দুর্গতির কবলে পড়ে তাকে কোনোভাবেই অবদমন সংশ্লিষ্ট মানুষের আয়ত্বের বাইরে সম্মুখ সমরে পানির স্রোতে ভাসমান অসহায়। নিরীহ জনগোষ্ঠী যে চরম দুর্বিপাকের শিকার হয় সেটাও নদী পাড়ের চরম সীমানায় অস্থায়ীভাবে স্থিতি হওয়া যেন দোদুল্যমান এক প্রাকৃতিক বৈরিতা। আর সমসংখ্যক নারীদের দুরবস্থা আরও বীভৎস এক চরম সর্বনাশা অনিশ্চিত দোলাচল। যা কোনোভাবেই সামলানো সম্ভব নয় উপকূলীয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। তবে শ্রেণি বিভক্ত সমাজে সবার আগে যে বিভাজন সমাজকে তাড়িত করে তা কিন্তু নারী-পুরুষের চিরায়ত ফারাক। একেবারে বিশ্ব সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে। যা আধুনিক উন্নত বিশ্বকেও আদিমতম প্রতিবেশ।
তবে ১৭৬০ সালের শিল্পবিপ্লব গোটা দুনিয়াকে নবতর এক আঙিনা উপহার দিলে কত কিছু যে বৈপরীত্য অবস্থার ঘানি টানার দুর্ভোগ চলে যায় তা বুঝতেও বিশ্ববাসিকে পুরো এক শতক অপেক্ষা করতে হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্ন থেকেই নিসর্গ বিজ্ঞানীরা জোরেশোরে আওয়াজ তুললেন প্রকৃতি যেন সহজাত নির্মল পরিবেশ থেকে ক্রমান্বয়ে বিচ্যুত হচ্ছে। সেখানে নিত্য নতুন গবেষণায় পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বললেন যান্ত্রিক কলা-কৌশল থেকে যে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে তাই প্রকৃতির নির্মল আবহকে বিনষ্ট করতে যথেষ্ট। সেখানে শুধুমাত্র ক্ষতিকারক বিষময় কার্বন নিঃসরণই নয় বরং সবুজ প্রকৃতির ওপর চরম দাবানলও ভর করেছে। আধুনিক উন্নত যন্ত্র সভ্যতা বিশ্বকে নিত্য নতুন আবিষ্কারে অন্যরকম বিশ্ব উপহার দিলেও ক্ষতিকারক কত কিছু নির্মল বায়ুতে নির্গমন করে যাচ্ছে তাও আর এক মাত্রার দূষণ প্রক্রিয়া। সবুজ বিশ্ব কিংবা ক্ষুদ্র বাংলাদেশ যন্ত্রসভ্যতার আকালে পড়ে যে প্রাকৃতিক বিপন্নতাকে সামলাচ্ছে তাও বিশ্বের সর্ববৃহৎ বদ্বীপ শ্যামল বাংলার ওপর প্রকৃতির প্রতিশোধই আগের মতো বর্ষাকাল আসার জন্য অপেক্ষমাণ থাকতে হচ্ছে না। জ্যৈষ্ঠের খরতাপে ফল পাকার ন্যক্কারজনক চিত্র। যা সংশ্লিষ্ট জনগণকে দুর্ভোগের আকালে আষ্টেপৃষ্ঠে উড়িয়ে রাখছে। তাকে সামাল দেওয়া সত্যিই এক কষ্টসাধ্য বিষয়।
যে কোনো বিপরীত প্রদাহে সবচেয়ে বেশি দুঃসময় পার করে অতি সাধারণ মানুষ। তা ছাড়া সমসংখ্যক নারীর জীবন ও সুস্থির আর নির্বিঘ্ন থাকা আরও কষ্টসাধ্য অন্য মাত্রায় বিপত্তি। পার্বত্য এলাকা খাগড়াছড়ি পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগত বৈশিষ্ট্য বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তার বিপরীত যাত্রাপথে যে চরম সংহার জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয় সেটাও এখন বিপরীত প্রতিক্রিয়ার দুঃসহ পালাক্রম। সংশ্লিষ্ট পাহাড়ি এলাকার জনজীবন হয় ভাঙা-গড়ার লাগাতার দুর্ভোগ এবং দুঃসময় পার করার চরম বাতাবরণ। পাহাড়ি অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষকর্তন যেমন পরিবেশের বিপত্তি, পাশাপাশি অযাচিত বাড়িঘর নির্মাণও পরিস্থিতিকে নয়ছয়ে নিয়ে যাওয়া। সচেতন সাবধানতায় এসব দুর্ভোগ আমলে আনতে যদি আরও সময় নষ্ট করা হয় তা হলে সংশ্লিষ্ট এলাকা বসবাসের অনুপযুক্ত হতেও দেরি লাগবে না। প্রকৃতি তার অবারিত দানে কোলের সন্তানদের ভরিয়ে দেয়। এমন নির্মল দানের বিপরীতে যে কোনো সংহার কিংবা দুর্ভোগ ডেকে আনার লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হলে নৈসর্গই নির্মম প্রতিশোধের দিশাহারা হচ্ছে। যে কোনো শক্তি আর সৌন্দর্য নষ্ট করতে সময় লাগে না। কেমন যেন চোখের পলকে হয়ে যায়। কিন্তু নতুন করে গড়ে তোলা ততোধিক কষ্ট। আর বিপন্নতা যেন পদে পদে। সমুদ্র পরিবেষ্টিত আর নদীমাতৃক আবহমান বাংলার রূপশৌর্যে অঞ্চলবাসীই বিমুগ্ধ নয় বরং ভিনদেশি পরিব্রাজক আর স্বদেশি কবি-সাহিত্যিকদের বন্দনায় যে শাশ্বত বাংলার অনন্য রূপময়তা, মাধুর্যস্নাত নির্মল আবহ তা কোনো বিপরীত শক্তির কোপানলে সবকিছু হারাতে বসেছে। এমনকি ঋতুবৈচিত্র্যকেও। তা খতিয়ে দেখা নিতান্ত জরুরি আগামীর নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়ায়।
প্যানেল