ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঠাকুরগাঁওয়ের ভাঙা রাস্তার বাঁকে বাঁকে দুর্ভোগ

আব্দুন নুর আজাদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঠাকুরগাঁও 

প্রকাশিত: ০১:৪৯, ৩১ মে ২০২৫

ঠাকুরগাঁওয়ের ভাঙা রাস্তার বাঁকে বাঁকে দুর্ভোগ

ঠাকুরগাঁও জেলা মানেই উত্তর সীমান্তের শান্ত গ্রামীণ জনপদ। কিন্তু সেই শান্তির পেছনে প্রতিদিন হাজারো মানুষের জীবন বাজি রেখে চলাফেরা—এমন বাস্তবতা লুকিয়ে থাকে।

রাস্তাঘাট আছে ঠিকই, কিন্তু সেবার চিহ্ন নেই। বছরের পর বছর কাটে—কাদামাটি, ধুলাবালি আর গর্তে ভরা পথেই চলে হেঁটে, ঠেলা রিকশায়, বাইকে কিংবা ভাঙা ভ্যানে।

তিনটি উপজেলা বালিয়াডাঙ্গী, হরিপুর ও রানীশংকৈল—সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে রয়েছে। সরকারি বাজেট আসে, প্রকল্প নেওয়া হয়—তবুও বদলায় না বাস্তবতা।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বেশিরভাগ গ্রাম এখনও কাঁচা সড়কের ওপর নির্ভরশীল। বড়পলাশবাড়ি থেকে আমজানখোর ইউনিয়ন পর্যন্ত সড়ক বৃষ্টির সময় যেন ধ্বংসস্তূপ হয়ে ওঠে।

স্কুলছাত্রী জান্নাতুল মাওয়া বলে, "ভ্যান চলে না, হেঁটে যেতে হয় কাদা ডিঙিয়ে। অনেকদিন স্কুল মিস হয়।"

এভাবে একটি প্রজন্ম শিখতে গিয়ে শিখছে কষ্ট সহ্য করা—এটাই যেন উন্নয়নের সংজ্ঞা।

হরিপুর উপজেলা সীমান্তবর্তী। এখানে অনেক রাস্তা বর্ষা মৌসুমে একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গেদুড়া থেকে ডাঙ্গীপাড়া পর্যন্ত সড়কটিতে ছোট ছোট পুকুরের মতো গর্ত।

দিনমজুর আবদুর রহিম বলেন, "একদিন কাজ করে আয় করি ৪০০ টাকা। কিন্তু ভ্যানে যেতে গিয়ে ভেঙে পড়ে গেলে চিকিৎসা বাবদ খরচ হয় ১০০০ টাকা। এটাই আমাদের জীবন।"

অনেক পরিবার জরুরি রোগী নিয়েও যেতে পারে না উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, রাস্তার ভয়ে।

রানীশংকৈলের কিছু এলাকা—যেমন বোরো বাজার থেকে লেহেম্বা পর্যন্ত রাস্তায় এত গর্ত যে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা সময়মতো ক্লাসে পৌঁছাতে পারে না। বর্ষাকালে অনেক মা-বাবা বাধ্য হয়ে সন্তানকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেন, কেবল দুর্ঘটনার ভয়ে।

স্থানীয় শিক্ষক মিজানুর রহমান জানান, "রাস্তাঘাট উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন অসম্ভব। কারণ স্কুলে যেতেই না পারলে পড়বে কীভাবে?"

সব নির্বাচনে মাইক বাজে—“রাস্তাঘাট উন্নয়ন করবো”, “পিচ ঢালাই করবো”, “ইউনিয়ন থেকে ইউনিয়ন এক করবো”—কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি গলে যায় বর্ষার পানিতে।

রাস্তা থাকে আগের মতোই—আর মানুষ শিখে গেছে নিজে নিজেই চলতে হয়, প্রশাসন দূরে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি ইউনিয়নে রাস্তা উন্নয়নের জন্য বছরে লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু মাঠে গেলে দেখা যায়:

কাজ হয় আংশিক। বিটুমিন দেয়ার পরেই উঠে যায়। ঠিকাদার বদলে যায়, কাজ ফেলে রাখে। মেরামত হয় কিছু অংশ, বাকি পড়ে থাকে।

চিলারং ইউনিয়নের একজন ওয়ার্ড সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "ঠিকাদাররা মাঝে মাঝে শুধু রোলার চালায় ছবি তোলার জন্য। তার পর আর কিছুই হয় না।"

বালিয়াডাঙ্গীর এক প্রসূতি মা বলেন, "বাচ্চার সময় লেগে গেছে, কিন্তু রাস্তা দিয়ে ভ্যানে নিতেও ভয়। শেষ পর্যন্ত ঘরে ডেলিভারি করতে হয়, আর বাচ্চা মারা যায়।"

ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত রাস্তাগুলোর চিত্র হলো—পোস্টারে উন্নয়ন, বাস্তবে ধ্বংস। যে সড়কে প্রতিদিন চলে জীবনযুদ্ধ, সেই সড়কই বারবার বঞ্চিত হয় সরকারের নজর থেকে। এখানে উন্নয়ন মানে পিচ ঢালা ছবি, টেন্ডার, উদ্বোধনের ব্যানার—কিন্তু মানুষের চাওয়া একটাই: “আমরা কাদা চাই না, চলার মতো রাস্তা চাই।”

রাজু

×