
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর দিকে তুরস্কের ইস্তান্বুুলে দেশ দুটির মধ্যে কয়েক দফায় আলোচনা হলেও যুদ্ধ বন্ধে কোনো পক্ষই সম্মত হয়নি। এর পর থেকে তিন বছরের বেশি সময় ধরে এ যুদ্ধ চলছে। রাশিয়া যুদ্ধে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, ঝাপোরিজ্জিয়া এবং খেরসন- এই চারটি প্রদেশ দখল করে নিয়েছে। মস্কোর প্রস্তাব ছিল, কিয়েভ যদি ক্রিমিয়াসহ এই চার প্রদেশকে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে। অন্যদিকে ইউক্রেনের বক্তব্য, রাশিয়া যদি অধিকৃত অঞ্চলগুলো থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়, শুধু তাহলেই শান্তি সংলাপে বসবে। পুতিন বলেছিলেন, ‘আমরা কিয়েভ সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি, তারা ২০২২ সালে যে আলোচনা ভেঙে দিয়েছিল, তা যেন আবার শুরু হয়। আর আমি জোর দিয়ে বলছি- এ আলোচনা হবে কোনো শর্ত ছাড়াই।’ এই প্রথম কোনো শর্ত না রেখেই ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছেন পুতিন। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রস্তাব টেবিলের ওপর আছে। এখন এটা ইউক্রেনের সরকার এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের ওপর নির্ভর করছে, যারা সম্ভবত জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা দ্বারা চালিত হয়।
গত ১৬ মে তুরস্কের ইস্তান্বুলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা শান্তি আলোচনা করেছেন। দুই দেশের মধ্যে তিন বছরেরও বেশি সময় পর এটাই প্রথম সরাসরি শান্তি আলোচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এতে ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ভ্লাদিমির পুতিন অংশগ্রহণ করেননি। ট্রাম্পও এ বৈঠকে বসার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে পরোক্ষভাবে তিনি পুতিনকে সেখানে আমন্ত্রণ জানালেও পুতিন শেষ পর্যন্ত সেখানে যেতে রাজি হননি। আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় ইউরোপীয় নেতাদের এক সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন, এ যুদ্ধ থামাতে আমাদের সামনে একটি বাস্তব সুযোগ ছিল। যদি না পুতিন তুরস্কে আসতে ভয় পেতেন। তিনি আরও বলেন, আমি প্রস্তুত ছিলাম পুতিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার জন্য, সেটা আঙ্কারা হোক বা ইস্তান্বুলে। শুধু সাক্ষাৎ নয়, গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে সমাধানের জন্যও আমরা প্রস্তুত। কিন্তু তিনি আমার কোনো প্রস্তাবেই সম্মত হননি। আলোচনার জন্য রাশিয়ার একটি নিম্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন তিনি। তবে আলোচনায় রাশিয়ার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দানকারী রুশ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ভ্লাদিমির মেদিনস্কি বলেছেন, ক্রেমলিনের এই প্রতিনিধি দলের সকল প্রয়োজনীয় দক্ষতা রয়েছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেন, যত দ্রুত সম্ভব একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা অত্যন্ত জরুরি। শান্তির জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে চাওয়ার ইচ্ছা দেখে তিনি আনন্দিত। ইস্তান্বুলের এ আলোচনা দুই দেশের নেতাদের মধ্যে একটি বৈঠকের ভিত্তি তৈরি করুক, এটাই তার চাওয়া। আমাদের সামনে দুটি পথ রয়েছে। একটি পথ শান্তির দিকে নিয়ে যাবে, অন্যটি আরও ধ্বংস ও মৃত্যুর দিকে। কে কোন্ পথ বেছে নেবে, তা উভয় পক্ষকেই তাদের নিজস্ব ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ইউক্রেনের প্রতিনিধি দলের প্রধান কিয়েভের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরে বলেন, শান্তি কেবল তখনই সম্ভব, যদি রাশিয়া প্রাথমিকভাবে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। ক্রেমলিন তার অবস্থান পরিবর্তন না করলে রাশিয়ার ওপর তাৎক্ষণিক নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকিও দিয়েছেন ইউরোপীয় নেতারা। এমন হুমকি সত্ত্বেও মস্কো তাদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, আল্টিমেটামের ভাষা রাশিয়ার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। মস্কো এই সংঘাতে শান্তি অর্জনের জন্য গুরুতর আলোচানা চায় বলে তিনি মন্তব্য করেন। ইউক্রেন ও তার মিত্ররা পুতিনের বিরুদ্ধে সময়ক্ষেপণের অভিযোগ এনে বলেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে শান্তি চাইছেন না। কিয়েভের ভাষ্য, বৈঠকে পুতিন উপস্থিত না থাকার অর্থ তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ইস্তান্বুলের এ আলোচনা থেকে যুদ্ধবিরতি নিয়ে অগ্রগতির সম্ভাবনা আগে থেকেই কম ছিল। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় সেই সম্ভাবনা আরও কমে যায়, যখন তিনি বলেন, তার সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠক না হলে কোনো অগ্রগতি হবে না। এদিকে রাশিয়ার প্রতিনিধিরা বলেছেন, তারা কূটনৈতিকভাবে যুদ্ধের অবসান চান এবং যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। তবে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ইউক্রেন এ যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের বাহিনীকে আবার সংগঠিত করতে, অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন এবং আবারও পশ্চিমা অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ইউক্রেনের প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার হলো একটি পূর্ণাঙ্গ, নিঃশর্ত ও সৎ যুদ্ধবিরতি, যা অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে, যেন মানুষ মারা যাওয়া বন্ধ হয়। আর যদি রাশিয়ার প্রতিনিধ দল একমত না হয়, তাহলে এটা একেবারে স্পষ্ট হবে যে, পুতিন কূটনীতিকে ধ্বংস করতে চাচ্ছেন। যদি রাশিয়ার প্রতিনিধ দল নাকচ করতে থাকে এবং কোনো বাস্তব সিদ্ধান্তে আসতে না পারে তবে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে রাশিয়ার জ¦ালানি খাত ও ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা জরুরি। বৈঠকের পূর্বে পুতিন বলেছিলেন, ১৫ মে ইস্তান্বুলে আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দিচ্ছি আমরা। ইউক্রেনের সঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করতে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি চলমান সংঘাতের মূলোৎপাটন করতে ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কথা বলতে চান। তিনি বলেন, আলোচনা চলাকালে আমরা একটি নতুন যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছি না। রাশিয়া যেসব বিষয়কে সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনের পশ্চিমাঘেঁষা কৌশলগত অবস্থান, ন্যাটোতে যোগদানের চেষ্টা, পূর্ব ইউক্রেনের রুশভাষীদের নিরাপত্তার মতো বিষয়। রাশিয়ার এ দাবিগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলো ও কিয়েভ সবসময়ই অগ্রহণযোগ্য বলে আসছে। তারা মনে করে, রাশিয়ার সামরিক অভিযান মূলত সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। ইউক্রেনের একটি সূত্র দাবি করছে, যুদ্ধবিরতির জন্য রাশিয়া ও দাবিগুলো বাস্তবতাবিচ্ছিন্ন ও অগ্রহণযোগ্য। রাশিয়া ইউক্রেনকে তার নিজস্ব ভূখণ্ড থেকে পিছু হটার দাবি জানিয়েছে, যাতে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা যায়। এটি এক কথায় ‘নন-স্টার্টার’ ও ‘অসংবেদনশীল’ শর্ত।
রাশিয়া ও ইউক্রেন তুরস্কে বৈঠকের পর এক যৌথ আলোচনায় এক হাজার যুদ্ধবন্দি একে অপরের সঙ্গে বিনিময়ে সম্মত হয়েছে। একইসঙ্গে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ও দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বৈঠকের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। বৈঠকে রাশিয়ার প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন ভ্লাদিমির মেদিনস্কি এবং ইউক্রেনের প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন রুস্তেম উমেরভ। পুতিনের বৈঠকে না থাকার সিদ্ধান্তে স্বভাবতই জেলেনস্কি ক্ষুব্ধ। তিনি অভিযোগ করে বলেন, রাশিয়ার পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধ করার কোনো সদিচ্ছা নেই। তিনি মন্তব্য করেন, এবারও যুদ্ধ বন্ধের কোনো সুরাহা না হলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের উচিত হবে কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। এর আগে ৩০ দিনের নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানাতে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও পোল্যান্ডের নেতারা একমত হয়েছেন। ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ড রাশিয়ার দখলে রয়েছে। ২০১৪ সালে দখলকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপও এর মধ্যে রয়েছে। তবে রাশিয়া বলেছিল, পশ্চিমা দেশগুলো যদি কিয়েভে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ না করে তাহলে কোনো যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নেই। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এ প্রসঙ্গে বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে অস্ত্র সহায়তা বন্ধ না করলে তারা সুবিধা পাবেন না। ইউক্রেন পূর্ণমাত্রায় সৈন্য মোতায়েন অব্যাহত রাখবে এবং নতুন সেনাদের ফ্রন্টলাইনে পাঠাতে থাকবে। তিনি আরও বলেন, ‘ইউক্রেন এ সময়ে নতুন সেনাদের প্রশিক্ষণ দিতে এবং সৈন্যদের বিশ্রাম দেওয়ার কাজে ব্যবহার করবে। তাহলে আমরা কেন ইউক্রেনকে এমন একটি সুবিধা দেব?’ এদিকে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে ‘জোকার ও ব্যর্থ ব্যক্তি’ বলে অভিহিত করেন। কারণ জেলেনস্কি রাশিয়ার প্রতিনিধ দলকে ‘ডামি’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের মধ্যে সরাসরি শান্তি আলোচনা হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই ইউক্রেনের উত্তর-পূর্ব দিকের সুমি অঞ্চলে বেসামরিক একটি বাসে রাশিয়ার ড্রোন হামলায় অন্তত ৯ জন নিহত হয়েছেন। ইউক্রেনের ন্যাশনাল পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটি শুধুই আরেকটি গোলাবর্ষণ নয়, এটি একটি ঠান্ডা মাথার যুদ্ধাপরাধ। তবে রাশিয়া বলছে, রুশ বাহিনী সুমি অঞ্চলে ইউক্রেনীয় সরঞ্জাম জড়ো করার একটি স্থানে ড্রোন হামলা চালিয়েছে।
দ্য টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, তুরস্কের ইস্তাম্বুলে শান্তি আলোচনায় রুশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বদানকারী ক্রেমলিনের সহযোগী ভ্লাদিমির মেডিনস্কি ইউক্রেনীয় প্রতিনিধি দলকে বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না। তবে এক বছর, দুই বছর, তিন বছর-যত দীর্ঘ সময় লাগে লড়াই করতে প্রস্তুত। আমরা ২১ বছর ধরে সুইডেনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। আপনি কতক্ষণ লড়াই করতে প্রস্তুত? এখানে উল্লেখ্য, ১৭০০ থেকে ১৭২১ সাল পর্যন্ত পিটার দ্য গ্রেটের শাসনামলে রাশিয়া এবং সুইডেনের মধ্যে ২১ বছর ধরে গ্রেট নর্দার্ন যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। পুতিন অবশ্য এর আগে সাবেক রুশ সম্রাটের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করেছেন। রাশিয়া অবশ্য শান্তি আলোচনা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছে, তারা ভবিষ্যতেও যোগাযোগ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত আছে। তবে রাশিয়ার সমালোচনা করে ইউক্রেন বলেছে, তারা কিয়েভের বাহিনীকে চারটি অঞ্চল থেকে প্রত্যাহারের দাবি করেছে। যখন ইউক্রেনীয় প্রতিনিধি দল চারটি অঞ্চল ছেড়ে দেয়ার দাবির তীব্র প্রতিবাদ জানায়, তখন রাশিয়ার আলোচকরা উত্তর দেন, পরের বার পাঁচটি হবে। এদিকে ট্রাম্প জানিয়েছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে তার সরাসরি বৈঠক না হওয়া পর্যন্ত ইউক্রেন সংকট নিয়ে কোনো অগ্রগতি হবে বলে তিনি আশা করছেন না। পুতিন তুরস্কে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ না করায় ট্রাম্প এমন মন্তব্য করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, ইউক্রেন ইস্যুতে কার্যকর সমাধানের জন্য রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনাই একমাত্র পথ হতে পারে। তুরস্কে পশ্চিমা সারিক জোট ন্যাটোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, তুরস্কে অনুষ্ঠেয় রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনা নিয়ে তার উচ্চাশা নেই। অগ্রগতি অর্জনের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে বৈঠক হওয়া দরকার। পুতিন বৈঠকে না থাকার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ জেলেনস্কি বলেন, রাশিয়ার যুদ্ধ থামানোর কোনো সদিচ্ছা নেই। তিনি বলেন, পুতিনের অনুপস্থিতি অসম্মানজনক। সেই অসম্মান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবং ট্রাম্পকেও করা হলো।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রুশ বাহিনীর সঙ্গে চলমান যুদ্ধে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার করে সেনা হারাচ্ছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। ছয় মাস ধরে এমন ঘটছে বলে একটি বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়টি আরও জানিয়েছে, মস্কোর বাহিনী ইউক্রেনের নোভোওলেক্সান্দ্রিভকা নামের একটি গ্রাম এবং উত্তর-পূর্বের এলাকা তোর্সকে দখল করে নিয়েছে। ইউক্রেনের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ওলেক্সান্ডার সিরস্কি বলেন, কিয়েভ ন্যায়সঙ্গত শান্তি চায়, তবে এখনো প্রায় ১,১০০ কিলোমিটারজুড়ে সক্রিয় লড়াই অব্যাহত রয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তাদের আগ্রাসনকে অবসাদমূলক যুদ্ধে পরিণত করেছে এবং তারা প্রায় ৬ লাখ ৪০ হাজার সৈন্যের যৌথ বাহিনী ব্যবহার করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। জেলেনস্কির প্রধান সহকারী আন্দ্রি ইয়ারমাক বলেন, রাশিয়া এই নতুন আলোচনাকে ২০২২ সালের ব্যর্থ আলোচনার ধারাবাহিকতা বানাতে চাচ্ছে। তাদের এই প্রচেষ্টা কখনই সফল হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তিন বছর পার হলেও শান্তি আলোচনায় চীনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। চীন বরং রাশিয়াকে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। চীন কখনোই এই যুদ্ধকে আগ্রাসন বলে স্বীকার করেনি। তাছাড়া জাতিসংঘে যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব উঠেছে, তখন চীন কিন্তু ভোট প্রদান থেকে বিরত থেকেছে। যুদ্ধ থামানো চীনের মূল উদ্দেশ্য নয়। তারা চায় গ্লোবাল সাউথ এবং ইউরোপে তাদের ভাবমূর্তি ভালো থাকুক।
ক্রেমলিন জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর পূর্বে পুতিন ও জেলেনস্কির মধ্যে বৈঠক সম্ভব নয়। দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ‘আমরা মনে করছি, এটি সম্ভব। তবে তা হবে দুই পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট কিছু ফলাফল অর্জনের পর। আপাতত তুরস্কে দুই দেশের প্রতিনিধিরা যে বিষয়ে একমত হয়েছেন, তা সম্পন্ন করা প্রয়োজন।’ পুতিনের সমালোচনায় জেলেনস্কি যদিও সরব, তবে ট্রাম্পকে বেশ সহানুভূতিশীলই মনে হচ্ছে। এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে গত ১৯ তারিখ পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলবেন বলেছেন ট্রাম্প। এই ফোনালাপ রক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা নিয়ে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে একটি সমঝোতায় আসতে এবং ওয়াশিংটন-মস্কো সম্পর্ক ঘিরে যে উদ্বেগ রয়েছে, তা সুরাহার জন্য এই ফোনকল আশার সঞ্চার করেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মারিনা মিরন মনে করেন, এই ফোনকল থেকে ৩টি ফলাফল আসার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে পুতিন ও ট্রাম্প কোনো এক ধরনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে পারেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে যুদ্ধবিরতি নিয়ে তারা ঐকমত্যে নাও পৌঁছাতে পারেন। আর তৃতীয়টি হচ্ছে দুই দেশের প্রেসিডেন্ট মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকতে পারেন। তবে তৃতীয়টি ঘটার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। ইউক্রেন রাশিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে এবং বিশ্বশক্তিদের কাছে থেকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চাচ্ছে। জেলেনস্কি এক্স-এ প্রদত্ত একটি পোস্টে লিখেছেন, ইউক্রেন প্রকৃত শান্তি আনার জন্য যত দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখাটা জরুরি। রাশিয়া যদি পূর্ণাঙ্গ ও নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি প্রত্যাখ্যান করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। রাশিয়া যুদ্ধবিরতির কথা বললেও তাদের কিছু শর্ত রয়েছে। তাছাড়া এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইউরোপেরও তেমন কোনো ভূমিকা নেই। পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যে আলোচনায় বিষয়টি সুরাহা না হলে আসলে ইউক্রেনের তেমন কিছু করারও থাকবে না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল