
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ভিসা নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চীনা শিক্ষার্থীদের জন্য দরজা ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে। সেই শূন্যতা এখন পূরণ করতে প্রস্তুত ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যাদের লক্ষ্য বিশ্বের শীর্ষ মেধাবীদের দলে টেনে আনা।
সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ঘোষণা দিয়েছেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের ভিসা ‘আক্রমণাত্মকভাবে’ বাতিল করবে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তি ও ধরে রাখার সুযোগ আটকে দেওয়া হয়, যেটিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ‘সমন্বয়ের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করে ট্রাম্প প্রশাসন।
এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্রুত সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কিংস্টন বিজনেস স্কুলের প্রধান শঙ্কর শিভারাজ জানাচ্ছেন, এখন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থার সংকটই ব্রিটেনের জন্য হয়ে উঠেছে সুযোগ। কারণ, চীনা শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে নতুন গন্তব্য খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন।
শিভারাজ এই নীতিকে হতাশাজনক ও অগ্রগতির পরিপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, এই সময়ে বৈচিত্র্যময় মেধা ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করাই ছিল শিক্ষাক্ষেত্রের মূল চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষাবর্ষ ২০২৩-২৪ সালে যুক্তরাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১,৪৯,৮৮৫ জন চীনা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ছিল, যা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কম। তবে পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে ইউকাস-এর ২০২৫ সালের জানুয়ারির আবেদনপত্র পর্যালোচনায়, যেখানে দেখা যায় চীনা আবেদনকারীর সংখ্যা ৮.৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১,১৬০ জনে।
শিক্ষাবিদদের মতে, যুক্তরাজ্যের প্রতি চীনা শিক্ষার্থীদের আকর্ষণের কারণ হলো সংক্ষিপ্ত মেয়াদের ডিগ্রি প্রোগ্রাম, তুলনামূলক কম খরচে জীবনযাপন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই সুবিধাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসার সুযোগ, যা যুক্তরাজ্যকে প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে রেখেছে।
বেয়েস বিজনেস স্কুলের নির্বাহী ডিন আন্দ্রে স্পাইসার সিএনবিসিকে জানান, বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে, অন্যদিকে ইউরোপিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত অবস্থান তৈরি করছে। তিনি বলেন, "লন্ডনে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বাইক যাত্রায় আপনি একাধিক বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় পেয়ে যাবেন।"
ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। কারণ দেশীয় শিক্ষার্থীদের ফি বহুদিন ধরেই স্থির রয়েছে এবং তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিভারাজ বলেন, "আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ফান্ডিং যুক্তরাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"
দ্য টেলিগ্রাফের এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, চীনা শিক্ষার্থীদের ফি থেকে ১৫৮টি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় বছরে প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন পাউন্ড আয় করে। এমনকি ২১টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মোট আয়ের ১০ শতাংশের বেশি নির্ভর করে চীনা শিক্ষার্থীদের ওপর।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রেসিডেন্ট ও প্রোভোস্ট মাইকেল স্পেন্স বলেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা যুক্তরাজ্যের জন্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
আগামী শিক্ষাবর্ষ শুরু হবে সেপ্টেম্বর থেকে। এর আগেই ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চীনা শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে নানা কৌশল নিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে চীনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়া, ২+১ প্রোগ্রামের মতো সুযোগ যেখানে শিক্ষার্থীরা দুই বছর চীনে এবং শেষ বছর যুক্তরাজ্যে পড়ার সুযোগ পান, এমনকি দেওয়া হচ্ছে বৃত্তির মতো আর্থিক প্রণোদনাও।
স্পাইসার মনে করেন, চীনা শিক্ষার্থীদের যুক্তরাজ্যে আগমন শুধু শিক্ষা নয়, ইউরোপের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমেও বড় ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, "একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ প্রবৃদ্ধির স্টার্টআপগুলোর একটি বড় অংশ প্রতিষ্ঠা করেছেন বিদেশি নাগরিকেরা, যারা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। এখন যদি আমরা সেই প্রতিভাকে ইউরোপে টানতে পারি, তাহলে লন্ডন, বার্লিন কিংবা প্যারিসের মতো শহরগুলোর স্টার্টআপ সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হবে।"
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নীতির কারণে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণে দ্রুত এগিয়ে আসছে যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। চীনা মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করতে এই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাজ্যের অবস্থান এখন অনেকটাই সুবিধাজনক। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে ব্রিটেন হতে পারে বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষার নতুন কেন্দ্র।
সূত্র:https://tinyurl.com/ycxa9e7h
আফরোজা