ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৪ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ফোন দেখা কখন ভালোবাসা হয়, আর কখন তা হয় ‘প্রেশার’? সম্পর্ক বোঝার সঠিক উপায়

প্রকাশিত: ১১:৩৭, ২ জুন ২০২৫; আপডেট: ১১:৩৭, ২ জুন ২০২৫

ফোন দেখা কখন ভালোবাসা হয়, আর কখন তা হয় ‘প্রেশার’? সম্পর্ক বোঝার সঠিক উপায়

ছ‌বি: সংগৃহীত

গভীর রাতে আপনার সঙ্গী কার সঙ্গে কথা বলছে তা নিয়ে কখনো কি সন্দেহ জেগেছে? কখনো কি মনে হয়েছে, স্রেফ নিজের মানসিক শান্তির জন্য হলেও দুজনের মধ্যে খোলা ফোন নীতিমালা চালু করা উচিত? যদি এমন কিছু মনে হয়ে থাকে, তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্যই।

এই সময়ে মোবাইল ফোন যেন আমাদের জীবনের এক নিবিড় অংশ—তাতে থাকে ক্যালেন্ডার, কথোপকথন, গোপনীয়তা, স্ক্রিনশট এমনকি কখনো কখনো আবেগের ছাপও। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, “খোলা ফোন নীতিমালা” এখন অনেক সম্পর্কের জন্য এক পরীক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একে অপরের ফোনে প্রবেশাধিকার দেওয়া কি ভালোবাসার নিদর্শন, নাকি সম্পর্কের ধ্বংসের সূচনা?

খোলা ফোন নীতিমালার পেছনের ‘ভালো অভিপ্রায়’

প্রথম দর্শনে, একে অপরের ফোনে প্রবেশাধিকার পাওয়া সহজ একটি ব্যাপার মনে হতে পারে। অনেক দম্পতির জন্য এটি কাজেও দিতে পারে। এটি বিশ্বাস, সংযোগ ও খোলামেলার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। পরামর্শদাতা মনোবিজ্ঞানী অ্যাবসি স্যাম বলেন, “কিছু দম্পতির মধ্যে পূর্ণ স্বচ্ছতা থাকে, এমনকি তারা একাউন্ট পর্যন্ত শেয়ার করেন। আবার কেউ কেউ আলাদা থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এটি সঠিক বা ভুল নয়, বরং যার যার স্বস্তির ওপর নির্ভর করে।”

অ্যাবসির মতে, খোলা ফোন নীতিমালার কিছু ইতিবাচক দিক হলো:

  • স্বচ্ছতা: অনেকের জন্য এটি উদ্বেগ কমায় এবং বিশ্বাস গড়ে তোলে।

  • সংযোগ: সঙ্গীর ডিজিটাল জগতের অংশ হওয়া যায়—শেয়ার করা মিম, বার্তা বা সেই অফিসের গল্প, যেটা বলার কথা ছিল কিন্তু বলা হয়নি।

  • ভরসা: যাঁদের মানসিক সংযুক্তির ধরণ উদ্বিগ্নতামূলক, তাঁদের জন্য এটি পরিত্যক্ত হওয়ার ভয় কমাতে সাহায্য করতে পারে।

  • সুবিধা: জীবনের অনেক কিছুই এখন ডিজিটাল, ফলে শেয়ার করা ফোন অনেক সময় ব্যবহারিক সুবিধাও দেয়।

তাই, মানসিকভাবে সুস্থ ও প্রস্তুত দম্পতিদের জন্য এটি একটি সান্ত্বনাদায়ক ও বন্ধন গঠনের উপায় হতে পারে।

কিন্তু সমস্যা কোথায়?

একটা কারণেই মানুষ সম্পর্কের মধ্যে কিছু ব্যক্তিগত জায়গা রাখতে চায়—এটি হলো নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো এক অবকাশ। অনেকেই প্রতিটি আপডেট শেয়ার করতে পছন্দ করেন, যদি দুইজনের মনোভাব একই রকম হয়, তবে তা ভালো। কিন্তু এক পক্ষ যদি এতে রাজি না হয়? তখনই সমস্যা শুরু হয়।

মনোবিজ্ঞানী ও লেখক আয়ান্না জাই বলেন, “খোলা ফোন নীতিমালাকে স্বচ্ছতার সমান ভাবা ভুল; এটি প্রায়ই নজরদারির মতো হয়ে দাঁড়ায়। যেমন টয়লেটের দরজা বন্ধ করে দেওয়া গোপনীয়তা নয় বরং ব্যক্তিগত অধিকার, তেমনি ফোনে প্রবেশাধিকার হওয়া উচিত পছন্দনির্ভর, নয়তো এটি এক ধরনের বিশ্বস্ততার পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।”

আয়ান্নার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, “অনেক সময় দেখা গেছে, যেসব সম্পর্কে খোলা ফোন নীতিমালা ছিল, সেখানেই প্রতারণার ঘটনা বেশি দেখা যায়। কারণ, যারা প্রতারণা করে, তারা এই গোপনীয়তার উত্তেজনাতেই মজা পায়। এটি প্রবেশাধিকার নয়, মানসিকতার বিষয়।”

সোজা কথায়, কেউ যদি মিথ্যা বলতে চায়, তাহলে বলবেই। ফোনে পাসওয়ার্ড না থাকলেও কেউ চাইলেই প্রতারণা করতে পারে।

আরেকটি বড় বিষয় হলো, যেটা একজনের কাছে “খোলামেলা” মনে হয়, সেটা আরেকজনের কাছে হতে পারে একপ্রকার অনুপ্রবেশ।

স্যাম বলেন, “যাদের অতীতে মানসিক নির্যাতন, গ্যাসলাইটিং বা নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁদের জন্য এমন প্রবেশাধিকার হুমকিস্বরূপ মনে হতে পারে। এটি লুকোচুরি নয়, বরং নিজের সত্তা টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন।”

তাহলে এটা কি আসলেই ফোনের ব্যাপার?

আসলে নয়।

আপনি কেন সঙ্গীর ফোন দেখতে চাইছেন, নিজেকে প্রশ্ন করুন। এটা কি আপনার মধ্যে কোনো সন্দেহ বা আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করার ফল? সঙ্গী কি হঠাৎ করেই ফোনে বেশি সময় কাটাচ্ছে? এর পেছনে একটা না একটা কারণ থাকেই। তাই সঠিক কাজ হলো, মুখোমুখি কথা বলা।

খোলা ফোন নীতিমালা অনিরাপত্তা দূর করতে পারে না। এটা আবেগগত ঘনিষ্ঠতার বিকল্প নয়। আর অবশ্যই এটি সঠিক যোগাযোগের জায়গা নিতে পারে না।

অ্যাবসি বলেন, “ফোন আসলে সমস্যা নয়। সমস্যা হলো পরিত্যক্ত হওয়ার ভয়, দুর্বল সীমারেখা, বা অতীতের অপূর্ণ ক্ষত। অনেক সময় মানুষ কৌতূহলবশত নয়, বরং ভয় থেকে সঙ্গীর ফোন পরীক্ষা করে—‘আমার জায়গা কেউ নিচ্ছে না তো?’”

তাই প্রবেশাধিকার দিয়ে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া গেলেও, মূল সমস্যার সমাধান হয় না।

তাহলে কী কাজ করে?

সঙ্গী কী করছে তা সবসময় জানলেও ভালো হয় না। বরং আবেগগত নিরাপত্তাই বেশি জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

  • খোলামেলা, অপ্রতিরক্ষামূলক আলোচনা: আপনার সন্দেহ, ভয় বা অনিরাপত্তা নিয়ে খোলামেলা কথা বলুন। কোনো কিছু ধরে নেবেন না, দোষারোপ থেকেও বিরত থাকুন।

  • স্বেচ্ছায় শেয়ার করা: যখন আমরা নিজেরা স্বচ্ছ হই, তখনই আসলে বিশ্বাস গড়ে ওঠে। যেমন, “আজকে আমার সাবেকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে, তোমাকে জানালাম” – এভাবে বললে সেটা অনেক বেশি আন্তরিক হয়।

  • ডিজিটাল সীমারেখা নির্ধারণ: আমরা শারীরিক সীমার কথা বলি, কিন্তু ডিজিটাল সীমা নিয়েও আলোচনা করা দরকার। যেমন, “আমি ব্রাউজিং হিস্টোরি শেয়ার করতে চাই না” মানে এই নয় যে আমি প্রতারণা করছি—এটা বলতে পারে যে আমি ব্যক্তিগত জায়গার মূল্য দিচ্ছি। এবং প্রয়োজনে এর পেছনের কারণ জানানো যেতে পারে।

  • বিশ্বাস গড়ে তুলতে দিন: বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এটি সময় নিয়ে, ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে হয়। অ্যাবসি বলেন, “আপনাকে একটা বন্ধ দরজা জোর করে খোলার দরকার নেই। কখনো কখনো দরজায় কড়া নাড়তে হয়, অপেক্ষা করতে হয়, আর ভেতর থেকে দরজা খোলার সুযোগ দিতে হয়।”

আয়ান্না জাই কথাটি এই বলে শেষ করেন, “শক্তি নজরদারিতে নয়, আত্মসম্মানে। আপনি অন্য কারও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। কিন্তু আপনি নিজের সম্মানবোধ এমনভাবে গড়ে তুলতে পারেন, যাতে প্রতারণার শিকার হলেও মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসতে পারেন।”

শেষ কথা: সম্পর্কের গভীরতা মাপার জন্য ফোন নয়, দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধা, নির্ভরতা এবং খোলামেলা যোগাযোগ।

আবির

×