
ছবি: সংগৃহীত
প্রায় ৫ হাজার বছর আগে ইউরোপে এক অজানা কারণে হঠাৎ করেই ধসে পড়ে তখনকার অন্যতম মানবসভ্যতা—নবপ্রস্তর যুগের কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী। দীর্ঘদিন ধরে গবেষকেরা ধারণা করছিলেন, এটি হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন বা কৃষিভিত্তিক বিপর্যয়ের কারণে। কিন্তু নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে—এই জনসংখ্যা ধ্বংসের পেছনে থাকতে পারে এক প্রাচীন রূপের প্লেগ সংক্রমণ।
‘Nature’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এই গবেষণায় ১০৮ জন প্রাগৈতিহাসিক মানুষের দেহাবশেষ থেকে উদ্ধারকৃত ডিএনএ বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা বলছেন, তৎকালীন স্ক্যান্ডিনেভিয়ার (ডেনমার্ক ও সুইডেন) বিভিন্ন কবরস্থান থেকে পাওয়া দেহে প্লেগ ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব মিলেছে ১৭ শতাংশ ক্ষেত্রে।
সুপ্রাচীন রোগ, সুগভীর প্রভাব
গবেষকদলের প্রধান ফ্রেডেরিক সিয়ারশলম, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের GeoGenetics Centre-এর পোস্টডক্টরাল গবেষক, বলেন—‘এই প্লেগ সংক্রমণকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না ভেবে বড় পরিসরের মহামারি ধরলে, তা নবপ্রস্তর যুগের জনগোষ্ঠী ধ্বংসের একটি শক্তিশালী ব্যাখ্যা হতে পারে।’
উল্লেখ্য, এই কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার বছর আগে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ইউরোপে এসেছিল এবং সেখানে কৃষিভিত্তিক বসতি স্থাপন করেছিল। তাদের স্থাপনার অন্যতম নিদর্শন হলো স্টোনহেঞ্জের মতো মেগালিথিক স্মৃতিস্তম্ভ।
কবরেই মিলল মহামারির প্রমাণ
প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ বলছে, এই জনগোষ্ঠীর ছয় প্রজন্মের মধ্যে চার প্রজন্মেই প্লেগ সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এটি ছিল না কোনো হঠাৎ বিস্ফোরক মহামারি, বরং সময় ধরে কয়েকবার ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সংক্রমণ।
গবেষকেরা বলেন, প্রতিটি সংক্রমণের ক্ষেত্রে Yersinia pestis ব্যাকটেরিয়ার জেনোমে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন—কখনো জিন হারানো, কখনো সংযোজন বা স্থানান্তর দেখা গেছে। গবেষকদের ধারণা, এসব পরিবর্তনেই রোগের ভয়াবহতা ধীরে ধীরে বাড়তে পারে।
তবে ‘ব্ল্যাক ডেথ’র মতো নয়
গবেষণায় ধরা পড়া প্লেগ ব্যাকটেরিয়ার জিনগত গঠন বলছে, এটি মধ্যযুগের ব্ল্যাক ডেথ মহামারির মতো ছিল না, যেটি ৭ বছরে ইউরোপের অর্ধেক মানুষকে হত্যা করেছিল। কারণ, এই প্লেগরূপে ফ্লি-পোকার মাধ্যমে ছড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় জিন অনুপস্থিত ছিল, যা ব্ল্যাক ডেথে পাওয়া যায়।
এটি ইঙ্গিত দেয়, তৎকালীন স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় এই প্লেগ মানব-মানব সংস্পর্শেই ছড়াতো, পশু থেকে নয়। তবে এটি কতটা প্রাণঘাতী ছিল, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সব দায় কি প্লেগের? গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ
তবে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইভোল্যুশনারি জেনেটিক্সের অধ্যাপক মার্ক থমাস, যিনি এই ‘নিওলিথিক পতন’ প্রথম চিহ্নিতকারী গবেষকদলের সদস্য ছিলেন, বলেন—'প্লেগই একমাত্র কারণ ছিল এমন নয়।’
তার মতে, নিম্নমানের কৃষিকাজ, মৃত্তিকার অবক্ষয়, অপুষ্টি ও রোগে ভোগা দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল তখনকার মানুষের দৈনন্দিন বাস্তবতা। ‘প্লেগ ছাড়া আরও অনেক জীবাণু তখন সক্রিয় ছিল, কিন্তু আমরা শুধু Yersinia pestis-এর ডিএনএ ভালোভাবে শনাক্ত করতে পারি বলে এটিই বেশি চোখে পড়ে,’ বলেন তিনি।
গবেষণার অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো ‘জেনেটিক টাইম ট্রাভেল’—যার মাধ্যমে হাজার হাজার বছরের পুরোনো রোগজীবাণুর ডিএনএ আজ বিশ্লেষণ করা সম্ভব। আর সেই ডিএনএ আমাদের জানাচ্ছে, একটি মহামারি কেবল মুহূর্তের ব্যাপার নয়, বরং দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা এক জটিল প্রক্রিয়া।
গবেষক সিয়ারশলম বলেন, ‘এটি কোনো দ্রুত মৃত্যুর জন্য দায়ী প্লেগ ছিল না, বরং কয়েক প্রজন্ম ধরে নীরবে মানুষকে দুর্বল করে তুলেছিল।’
সূত্র: সিএনএন।
রাকিব