
ছবি: সংগৃহীত
"আচ্ছা বলুন তো, আসমান না জমিন—কোনটি আগে সৃষ্টি হয়েছে?"—এই প্রশ্ন করলে কেউ বলবেন আসমান আগে সৃষ্টি হয়েছে, আবার কেউ বলবেন না, জমিনই আগে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু নিশ্চিত করে কেউই সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না। কারণ প্রশ্ন যেমন জটিল, উত্তরটাও তেমনি রহস্যময়। আজ আমরা চেষ্টা করব কোরআন এবং আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের কী বলে, সেই বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই রহস্য উদ্ঘাটন করতে।
কোরআনে কী বলা হয়েছে?
প্রথমে দেখা যাক কোরআন কী বলছে। সূরা বাকারার ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে—
"তিনিই সেই সত্তা, যিনি পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেছেন।"
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, আগে জমিন সৃষ্টি হয়েছে, পরে আল্লাহ আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেছেন।
কিন্তু অন্যদিকে সূরা নাজিয়াতের ২৭-৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে—
"তোমাদের সৃষ্টি অধিক কঠিন, না আকাশের, যা তিনি নির্মাণ করেছেন? তিনি একে উচ্চ করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন, এর রাত করেছেন অন্ধকারময় এবং এর দিনের আলো উজ্জ্বল করেছেন। এরপর তিনি জমিনকে বিস্তৃত করেছেন।"
এখানে দেখা যায়, আগে আসমান সৃষ্টি হয়েছে, পরে জমিন।
এতে মনে হতে পারে কোরআনের দুইটি সূরায় বিরোধপূর্ণ তথ্য রয়েছে। তবে আরও একটি সূরা—ফুসসিলাত—এর ৯-১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
"বল, তোমরা কি অস্বীকার করছো সেই সত্তাকে যিনি দু’দিনে জমিন সৃষ্টি করেছেন... তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধোঁয়ারূপে..."
এখানেও বোঝা যায়, আগে জমিন, পরে আসমান। কিন্তু আসলেই কি এসব আয়াতের মধ্যে কোনো বিরোধ আছে?
বিজ্ঞান কী বলছে?
আধুনিক বিজ্ঞান বলে, মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল বিগ ব্যাং দিয়ে—প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে। এরপর হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের গ্যাস সারা মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে, যা নেবুলা বা মহাজাগতিক ধোঁয়া হিসেবে পরিচিত। এই ধোঁয়া থেকেই গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সির জন্ম হয়। অর্থাৎ, প্রথমে আসমানের মৌলিক উপাদান সৃষ্টি হয়েছে, তারপর ধাপে ধাপে গ্রহপুঞ্জ গঠিত হয়েছে, যার অংশ হিসেবে আমাদের পৃথিবী।
বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর, যা পুরো মহাবিশ্বের বয়সের তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ আসমান আগে, পরে জমিন—এটি বৈজ্ঞানিকভাবে সমর্থিত তথ্য।
তাহলে কোরআন ও বিজ্ঞানের মধ্যে বিরোধ?
প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে, সূরা বাকারা ও সূরা ফুসসিলাতে বলা হয়েছে জমিন আগে, আর সূরা নাজিয়াতে বলা হয়েছে আসমান আগে। কিন্তু কোরআনের শব্দ ব্যবহারে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়—আসলে কোনো বিরোধ নেই।
আল্লাহ তাআলা জমিন সৃষ্টির ক্ষেত্রে "খালাকা" (সৃষ্টি করা) শব্দ ব্যবহার করেছেন। এর মানে—কিছু না থেকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি করা। কিন্তু আসমান সম্পর্কে বলা হয়েছে "সুম্মা স্তাওয়া ইলাস সামা"—অর্থাৎ তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেছেন। এখানে "সৃষ্টি করেছেন" বলা হয়নি। বরং সূরা ফুসসিলাতে বলা হয়েছে আকাশ ছিল ধোঁয়ারূপে—"দুখান"।
আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে ঠিক সেটাই—"Early universe was filled with dark gas clouds." অর্থাৎ—আকাশ আগে থেকেই ছিল, তবে ধোঁয়ার মতো অসংগঠিত অবস্থায়।
মুফাসসিরগণের ব্যাখ্যা
বিভিন্ন মুফাসসির এই বিষয়টি বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে:
“আয়াতগুলোর মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো বিরোধ নেই। আল্লাহ প্রথমে জমিন অবিন্যস্তভাবে সৃষ্টি করেছেন, এরপর আকাশ সৃষ্টি করেন এবং শেষে জমিনকে বিস্তৃত করে তাতে পাহাড়-নদী-উদ্ভিদ সৃষ্টি করেন।”
প্রখ্যাত সাহাবি ইবনে আব্বাস (রা.)-কে যখন এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি বলেন:
"প্রথমে পৃথিবীর মৌলিক উপাদান তৈরি হয়েছে। তখন আকাশ ছিল ধোঁয়ারূপে। পরে পৃথিবীকে বিস্তৃত করে, তাতে জীবজগৎ সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর আকাশকে স্তরে স্তরে সাজানো হয়েছে।"
কোরআন কি বিজ্ঞানের বই?
না, কোরআন কোনো বিজ্ঞানের পাঠ্যবই নয়। আবার বিজ্ঞানও সব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সত্য নয়—বিজ্ঞান নিরবিচারে পরিবর্তনশীল। কিন্তু কোরআনের প্রতিটি শব্দ অপরিবর্তনীয় ও চিরন্তন। অনেক তথ্য বিজ্ঞান এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি, যা কোরআনে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বলা হয়েছে।
শেষ কথা হলো—আসমান আগে না জমিন, তার উত্তর নির্ভর করে আপনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন।
উপাদানগত দিক থেকে: আগে আসমান (ধোঁয়ারূপে)।
গঠন ও সাজানোর দিক থেকে: আগে জমিন (প্রসারিত ও প্রাণবান)।
এভাবে দেখলে বোঝা যায়, কোরআনের বর্ণনা ও আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব একই সূঁচের দুটি দিক। বাহ্যত কিছু বিভ্রান্তি থাকলেও গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়—আসমান ও জমিন সৃষ্টির রহস্যে কোরআন ও বিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক।
ফরিদ