
ছবি: সংগৃহীত
আসমান-জমিন এবং এ দুয়ের মাঝে যা কিছু রয়েছে—জানা-অজানা—সবই সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ তাআলা। তিনি তাঁর মহিমা প্রকাশের উদ্দেশ্যে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু কখনো কি আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে—আল্লাহ ঠিক কীভাবে এ বিশাল সৃষ্টি কার্য সম্পন্ন করেছেন? কত সময় লেগেছে এই সৃষ্টিতে? সব কিছু কি মুহূর্তেই সৃষ্টি হয়ে গেছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা যাক কোরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে।
আসমান-জমিন সৃষ্টি হয়েছে ছয় দিনে
সূরা আরাফের ৫৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে—
“নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি ছয় দিনে আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন। দিনকে তিনি রাতের পর্দা দিয়ে আবৃত করেন, যা একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করে। সূর্য, চন্দ্র, ও নক্ষত্ররাজি তাঁরই নির্দেশে পরিচালিত হয়। জেনে রেখো, সৃষ্টিও তাঁর, নির্দেশও তাঁরই। বরকতময় আল্লাহ, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।”
একইরকম বর্ণনা এসেছে সূরা ফুরকানের ৫৯ নম্বর আয়াতে, যেখানে বলা হয়েছে—
“তিনি ছয় দিনে আসমান, জমিন এবং এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে, সব সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে সমাসীন হয়েছেন। তিনিই পরম দয়ালু। তাঁকে জিজ্ঞেস করো, যিনি এসব বিষয়ে অবগত।”
এই ছয় দিনে সৃষ্টি প্রসঙ্গে কোরআনের আরও ছয়টি স্থানে উল্লেখ আছে:
- সূরা ইউনুস (আয়াত ৩)
- সূরা হুদ (আয়াত ৭)
- সূরা হা-মীম আস সাজদা (আয়াত ৪)
- সূরা ক্বাফ (আয়াত ৩৮)
- সূরা হাদীদ (আয়াত ৪)
এ সবগুলো আয়াতে আল্লাহর সৃষ্টিকর্মের সময়কালকে ছয় দিন বলা হয়েছে।
হাদিসে ছয় দিনের পরিচয়
সহীহ হাদিসে এসেছে—এই ছয় দিন হলো:
- রবিবার
- সোমবার
- মঙ্গলবার
- বুধবার
- বৃহস্পতিবার
- শুক্রবার
শুক্রবার আসরের আগেই আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টি সম্পন্ন করেন। তারপর আসর থেকে দিনের শেষ মুহূর্তে আল্লাহ আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। আর শনিবারকে বলা হয় “ইয়াওমুস সাবত”, অর্থাৎ ছিন্ন করার দিন—এই দিন কোনো সৃষ্টি হয়নি, বরং সৃষ্টি কাজ সমাপ্ত হয়েছিল।
কোন দিনে কী সৃষ্টি করা হয়েছিল?
এই বিষয়ে সূরা ফুসসিলাতের ৯–১২ আয়াত গুরুত্বপূর্ণ।
আয়াতে বলা হয়েছে: “বলো, তোমরা কি তাঁর প্রতি কুফর করো, যিনি দুদিনে জমিন সৃষ্টি করেছেন...? তারপর তিনি জমিনে পর্বতমালা স্থাপন করলেন, বরকত দিলেন, আর তার খাদ্যশস্য নির্ধারণ করলেন চার দিনে। তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করলেন, যা ছিল ধোঁয়ায় পূর্ণ। তিনি বললেন, ‘তোমরা উভয়ে (আকাশ ও জমিন) ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এসো।’ তারা বলল, ‘আমরা অনুগত হয়ে এসেছি।’ তারপর তিনি দুদিনে সাত আকাশ সৃষ্টি করলেন...।“
মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী:
- রবিবার ও সোমবার: জমিন সৃষ্টি
- মঙ্গলবার ও বুধবার: পর্বত, নদী, গাছপালা, খনিজ, খাদ্য ইত্যাদি
- বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার: সাত আসমান সৃষ্টি
সুতরাং মোট ছয় দিনে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পন্ন হয়।
এই ছয় দিন কেমন ছিল?
প্রশ্ন আসতে পারে—এই ছয় দিন কি আমাদের দুনিয়ার দিনের মত? যেমন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত?
উত্তর হলো—না, এসব দিন আমাদের দুনিয়ার দিনের মত ছিল না। কারণ:
- সে সময় চাঁদ-সূর্য, দিন-রাত্রির নিয়ম ছিল না
- এটি ছিল আল্লাহর উর্ধ্বজগতের ব্যাপার
- সময় ছিল আল্লাহর নিজস্ব মাপকাঠিতে, মানুষের মতো নয়
- এই দিনগুলো আসলে ধারাবাহিকতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, সময় পরিমাপ বোঝাতে নয়।
আল্লাহ কি এক কথায় সব সৃষ্টি করতে পারতেন না?
আল্লাহ বলেন: “যখন তিনি কোনো কিছু করতে চান, তখন শুধু বলেন ‘হও’, সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে যায়।” (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৮২)
তাহলে কেন আল্লাহ ছয় দিন সময় নিলেন?
এ বিষয়ে মুফাসসির ও আলেমগণ বলেন, এই ছয় দিন সময় নেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন—পর্যায়ক্রমিকভাবে ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করতে হয়।
তাফসীরবিদ সাঈদ ইবনে জুবাইর (রহ.) বলেন—আল্লাহ চাইলে এক মুহূর্তেই সব সৃষ্টি করতে পারতেন, কিন্তু ছয় দিনে সৃষ্টি করে তিনি মানুষের কর্মপদ্ধতি ও শৃঙ্খলার শিক্ষা দিতে চেয়েছেন।
সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী?
এই মহাবিশ্বের প্রতিটি কণায় রয়েছে আল্লাহর পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য। সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হলো—সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধি সৃষ্টি করা।
যেমন— স্থাপত্য দেখে স্থপতি চেনা যায়, লেখা দেখে লেখক বোঝা যায়, কবিতা দেখে কবি চেনা যায়—তেমনি এই বিশ্বজগত দেখেও আমরা স্রষ্টা আল্লাহকে চিনে নিতে পারি।
মহান আল্লাহ ছয় দিনে আসমান-জমিন এবং এর মাঝে যা কিছু আছে, সব সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি স্তরে রয়েছে নিখুঁত পরিকল্পনা, নিয়ম ও উদ্দেশ্য। এই সৃষ্টি আমাদের শেখায় ধৈর্য, পরিপূর্ণতা এবং এক মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব ও মহিমা উপলব্ধি করা।
ফরিদ