
সেনাবাহিনীর কঠিন নিয়মতান্ত্রিক জীবন থেকে অবসর নিয়ে সিনহা ছুটে বেড়াতেন ভ্রমণের নেশায়। সেই নেশাতেই তিনি গিয়েছিলেন কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে। এক মাস যাবৎ অবস্থান করছিলেন কক্সবাজারের হিমছড়িতে। ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানাতে সিনহার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী—সাহেদুল ইসলাম সিফাত, শিপ্রা দেবনাথ এবং তাহসিন রিফাত নূর।
কক্সবাজার অবস্থানকালে ওসি প্রদীপের নামে বিভিন্ন অভিযোগ শুনতে পান সিনহা।লোকমুখে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবন-জীবিকার তথ্য সংগ্রহ করার সময় ওসি প্রদীপের মাদক নির্মূলের নামে টেকনাফ থানার নিরীহ মানুষের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের তথ্য জানতে পারেন। নির্যাতনের শিকার অনেক পরিবারের সদস্য সিনহা এবং তার সহযোগীদের কাছে প্রদীপের অত্যাচার-নীপিড়নের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন।
এসব শুনে সিনহা এবং তার সহযোগীরা ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী এবং তাদের পেটুয়া বাহিনীর নাম সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
এসব কাজের এক পর্যায়ে ওসি প্রদীপের সঙ্গে সিনহা মো. রাশেদ, শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতের দেখা হয়ে যায়। তখন তাদের সঙ্গে ক্যামেরাসহ ভিডিও ধারণের নানা সরঞ্জাম ছিল। তখন প্রদীপ তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং তাদের এসব কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। ওসি প্রদীপ এ-ও বলেন, তিনি মেজর-টেজরের ধার ধারেন না। তিনি বহু সাংবাদিককে পিটিয়েছেন, জেলে পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের ভয়ভীতি দেখান, হুমকি দেন এবং কক্সবাজার জেলা ছেড়ে যেতে বলেন।
প্রদীপের ধারণা ছিলো হুমকি দিলেই সিনহা কক্সবাজার ত্যাগ করবে। কিন্তু কক্সবাজার ত্যাগ না করায় সিনহাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
ওসি প্রদীপের হুমকির বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে সিনহা এবং তার সঙ্গীরা নীলিমা রিসোর্টে অবস্হান করেই প্রামাণ্যচিত্রের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তারা কক্সবাজার না ছাড়ায় ওসি প্রদীপের সন্দেহ হয় সিনহা মো. রাশেদ সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসার পরিচয় দিয়ে টেকনাফে তার থানা এলাকায় তার নানা কুকর্মের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করছে।
এসব অপকর্মের বিষয়গুলো প্রচার হলে চাকরির ক্ষতি হবে অনুধাবন করে বিষয়টি ওসি প্রদীপ বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে জানান।
ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সিফাতকে সঙ্গে নিয়ে হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্ট থেকে বের হন সিনহা। নিজের গাড়ি চালিয়ে মুইন্না পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেদিন পথঘাট ছিল একেবারেই ফাঁকা। বের হওয়ার সময় সিনহার পরনে ছিল কমব্যাট প্যান্ট ও টি-শার্ট; সঙ্গে ছিল ক্যামেরাসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি।
ঐ বিকেলে একটি ‘টাইমল্যাপস’ ভিডিও ধারণের জন্য পাহাড়ের ওপর থেকে সাগর ও আশপাশের দৃশ্য ধারণ করছিলেন সিনহা ও তার সঙ্গী সিফাত। একসময় বেলা পড়ে গিয়ে দিনের আলো ফিকে হয়ে অন্ধকার নেমে আসে।
এই সময়ই টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর নির্দেশে মেজর সিনহার দলের ওপর নজর রাখতে বলা হয় স্থানীয় পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দীন এবং মোহাম্মদ আইয়াজকে। তারা জানতে পারেন, দুজন ব্যক্তি ভিডিও করতে পাহাড়ে উঠেছেন; তাঁদের একজনের পরনে সেনাবাহিনীর মতো পোশাক।
র্যাবের অভিযোগপত্রে বলা হয়, সুযোগ পেলে ‘ডাকাত’ বলে প্রচার করে ওই ‘ভিডিও পার্টি’কে গণপিটুনি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রদীপ। সে অনুযায়ী তিন সোর্স সিনহা ও তার সঙ্গীকে ডাকাত হিসেবে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা করেন।
তারা প্রথমে মুইন্না পাহাড়ের কাছে দক্ষিণ মারিশাবুনিয়া জামে মসজিদের মাইকে ‘পাহাড়ে ডাকাত দেখা যাচ্ছে’ বলে ঘোষণা দেন। ঘোষণা শুনে লোকজন জড়ো হয়, কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে তারা ফিরে যায়।
রাত ৮টার দিকে পুলিশের তিন সোর্স মাথাভাঙ্গা মসজিদের ইমাম জহিরুলকে ডাকাতের ঘোষণা দিতে বলেন। বর্ণনা শুনে ইমাম জানান, যাঁকে ডাকাত বলা হচ্ছে, তিনি সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর; পাহাড়ে ওঠার সময় তার সঙ্গে দেখা হয়েছে।
তখন পাহাড় থেকে নেমে আসছিলেন মেজর সিনহা ও তার সঙ্গী সিফাত। পুলিশের ওই তিন সোর্স তাঁদের মুখে টর্চের আলো ফেলে নিশ্চিত হন যে এঁদেরই খুঁজছিলেন ওসি প্রদীপ।
তারা সিনহা ও সিফাতের পেছন পেছন মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত আসেন। সিনহা নিজের গাড়িতে উঠলে রাত ৮টা ৪৭ মিনিটে সোর্স নুরুল আমিন বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীকে ফোন করে জানান যে, সিনহা গাড়ি চালিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছেন। পরবর্তী তিন ঘণ্টায় নুরুলের সঙ্গে লিয়াকতের ১৫ বার ফোনালাপ হয়।
নুরুলের ফোন পাওয়ার পরপরই লিয়াকত আলী কোনো ফোর্স ছাড়াই এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতের মোটরসাইকেলে চড়ে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে গিয়ে অস্ত্রসহ অবস্থান নেন।
মেরিন ড্রাইভে বিজিবি এবং এপিবিএনের দুটি চেকপোস্ট রয়েছে। সিনহার গাড়িটি রাত ৯টা ২০ মিনিটে বিজিবি চেকপোস্ট অতিক্রম করে। সেখানে পরিচয় জানার পর বিজিবি সদস্যরা স্যালুট দিয়ে তাকে যেতে দেন। পাঁচ মিনিট পর গাড়িটি শামলাপুর চেকপোস্টে পৌঁছায়। সেখানেও গাড়িটি থামানোর সংকেত দেওয়া হয়।
এপিবিএনের কনস্টেবল রাজীব পরিচয় জানতে চাইলে সিফাত জানালা খুলে দেন। সিনহা নিজের পরিচয় দেন এবং পুলিশের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। রাজীবসহ এসআই শাহজাহান আলী ও কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন স্যালুট দিয়ে গাড়িটিকে চলে যাওয়ার সংকেত দেন।
এসময় লিয়াকত আলী গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সিনহার নাম শুনেই উত্তেজিত হয়ে তিনি সামনে এসে রাস্তা আটকিয়ে দাঁড়ান।
এরপর গাড়ির আরোহীদের দুই হাত তুলে নামতে বলেন লিয়াকত। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে আশপাশের লোকজন জড়ো হন। আলোর ঝলকানিতে মসজিদ ও বাজার থেকেও অনেকে তা প্রত্যক্ষ করেন।
লিয়াকতের নির্দেশে সিফাত প্রথমে দুই হাত তুলে গাড়ি থেকে নামেন। সিনহাও একইভাবে হাত তুলে গাড়ি থেকে নেমে ইংরেজিতে ‘Calm down, calm down’ বলে লিয়াকতকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
এই সময় লিয়াকত প্রথমে দুটি ও পরে কয়েক কদম এগিয়ে আরও দুটি গুলি করেন সিনহার ওপর। গুলিতে সিনহা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর তিনি ও সিফাতকে হাতকড়া পরানোর নির্দেশ দেন লিয়াকত। এসআই নন্দ দুলাল গুলিবিদ্ধ সিনহাকে হাতকড়া পরান। এসআই শাহজাহানের কাছে হাতকড়া না থাকায় বকাঝকা করেন লিয়াকত এবং বাজার থেকে রশি এনে সিফাতকে বাঁধতে বলেন। পরে কনস্টেবল আব্দুল্লাহ রশি এনে দেন।
রাত সাড়ে ৯টার দিকে লিয়াকত ফোনে ওসি প্রদীপকে ঘটনা জানান। পরে তিনি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকেও ফোন করেন।
র্যাবের অভিযোগপত্রে বলা হয়, তখনো মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন এবং পানি চাচ্ছিলেন। উত্তরে লিয়াকত বলেন, ‘তোকে গুলি করেছি পানি খাওয়ানোর জন্য না।’ এরপর লিয়াকত সিনহার বুকের বাম পাশে লাথি মারেন ও মাথায় পা চেপে ধরেন।
এরপর আরও পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। লিয়াকতের নির্দেশে তারা গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ক্যামেরা, ভিডিও সরঞ্জাম, কিছু কাগজপত্র ও একটি পিস্তল উদ্ধার করেন। কোনো মাদক পাওয়া যায়নি।
পরে ওসি প্রদীপ ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে আসেন। সিনহা তখনো বেঁচে ছিলেন এবং পানি চাইছিলেন। প্রদীপ তাকে গালিগালাজ করে বুকে লাথি মারেন এবং জুতার পা দিয়ে গলায় পাড়া দিয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ পরই সিনহার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়।
এরপরও সিনহার মরদেহ কিছু সময় সড়কে ফেলে রাখা হয়। এরপর প্রদীপের নেতৃত্বে পুলিশ আবার গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে মাদক থাকার কথা ঘোষণা করে। পরে সিফাতকে নির্যাতনের জন্য চেকপোস্টের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মুখে পানি ঢেলে নির্যাতন করা হয়।
রাত ১০টার দিকে এক স্থানীয় গাড়ি থামিয়ে তাতে প্রায় ৪০ মিনিট পর মেজর সিনহাকে তোলা হয় এবং হাসপাতালে পাঠানো হয়। অথচ পুলিশের অন্য গাড়িগুলোতে তৎক্ষণিকভাবে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি।
ঘটনার পর মামলার সাক্ষী সেনাবাহিনীর রামু ক্যান্টনমেন্টের সার্জেন্ট আইয়ুব আলী ঘটনাস্থলে গেলে তার সঙ্গে পুলিশ দুর্ব্যবহার করে এবং ঘটনাস্থল থেকে তাড়িয়ে দেন। এছাড়াও হত্যার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে মেজর সিনহা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পর পর তিনটি সাজানো ও বানোয়াট মামলা দায়ের করে পুলিশ।
সানজানা