
একজন মেজর, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া সাহসী কণ্ঠস্বর- এভাবেই জিয়াউর রহমানের পরিচয়ের সূচনা। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। যুদ্ধজয়ের পর তিনি গড়ে তুলেছেন এক নতুন যুদ্ধের মঞ্চ- শান্তির, উন্নয়নের, রাষ্ট্র বিনির্মাণের। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে এসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেখিয়েছিলেন কীভাবে একজন সেনানায়ক রাজনীতির কাদা-জলে না নেমেও জনতার আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করেননি, গড়ে তুলেছিলেন এক বিশ্বাস, এক আদর্শ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা স্বকীয় আত্মপরিচয়ের আন্দোলন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে, কৃষকের হাত ধরে, শ্রমিকের কাঁধে হাত রেখে, ছাত্রদের স্বপ্ন দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘এই দেশ কারো করুণা নয়, এই দেশ আমাদের পরিশ্রমে গড়া হবে।’ তিনি রাজনীতিকে একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা জনগণের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। নিজের ব্যক্তিত্ব, সততা ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জিয়াউর রহমান রূপ নিয়েছিলেন একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়কে, যিনি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি কেবল রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘জনতার জিয়া’। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল গুলিতে। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন, আদর্শ ও নাম আজও কোটি মানুষের হৃদয়ে জ্বলজ্বলে জীবন্ত। মহান নেতার মৃত্যুসংবাদে স্তব্ধ হয়েছে বাংলাদেশ।
১৯৮১ সালের ৩০ মে। ভোর হতে তখনো একটু বাকি। পাখিরা ডেকে ওঠেনি, নদীতে ঢেউ ওঠেনি, শহরের রিক্সার চাকা গড়ায়নি। কিন্তু সেই নীরব সকাল হয়ে উঠেছিল জাতীয় হৃদয়বিদারক এক ভোর, যেদিন প্রতিটা গুলি বাংলাদেশের কোটি মানুষের বুক ভেঙে দিয়েছিল। ঢাকা তখনো ঘুমন্ত শহর। ফজরের নামাজ পড়ার জন্য কেউ কেউ হেঁটেছেন মসজিদের দিকে, কেউ চায়ের দোকান খুলছেন। হঠাৎ রেডিও থেকে ভেসে আসে এক রুদ্ধশ্বাস সংবাদ- ‘রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে...।’ প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি। এক চা দোকানি চাচা কাঁপা গলায় বলেন, ‘কী বললা? জিয়া নাই? এইটা মিথ্যা হবে ভাই... এইটা হইতেই পারে না।’ কেউ রেডিওর ভলিউম বাড়ায়, কেউ কাঁধে মাথা রাখে। সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান খুন হয়েছেন!
শহীদ জিয়ার জন্মভূমি বগুড়ায় খবর পৌঁছাতে সময় লাগেনি। সেই সকালে প্রতিটি চৌরাস্তার মোড়ে, হাটে-বাজারে, স্কুলে, এমনকি গ্রামের খেতেও শুধু একটাই কথা- ‘আমাদের পোলাডারে মাইরা ফালাইছে...’ মায়েরা কাঁদছেন, যেন নিজের সন্তান হারিয়েছেন। বৃদ্ধরা নামাজ পড়ে রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়ার জন্য দোয়া পড়ছেন। এক বৃদ্ধ কৃষক বললেন, ‘জিয়া আছিল গরিবের স্বপ্ন। ও চলে গেল, আমরাও অন্ধ হইলাম।’ চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা, খুলনা থেকে ঠাকুরগাঁও দেশজুড়ে শোকের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। রেডিও-টেলিভিশনে একটাই খবর, পাড়ায়-মাঠে একটাই আলোচনা। মাদ্রাসার ছাত্র কান্না জড়ানো কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করে শহীদ জিয়ার রুহের মাগফিরাত চায়। ইমাম সাহেবরা বলেন, ‘তিনি ছিলেন আমানতদার। তাঁর হাতে আমরা দেশটারে দেখছিলাম।’ ঢাকায় প্রেস ক্লাবের সামনে, বিএনপির অফিসে, মসজিদের বারান্দায় মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকে হাঁটু গেড়ে বসে, মাথা ঠেকায় মাটিতে। একজন মানুষ মারা গেলে তাঁর শরীর চলে যায়, কিন্তু আদর্শ বেঁচে থাকে। রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান চলে গেছেন বহু বছর আগে, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া চিন্তা, চরিত্র ও আদর্শ আজও প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে জীবন্ত।
রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান ছিলেন এক অনন্য রাষ্ট্রনায়ক। ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ নামে একটি নতুন আত্মপরিচয়ের বীজ বপন করেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশী। আমাদের আছে একক ভূখণ্ড, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও চেতনা।’
তিনি শহরে থেকে গ্রামে গেছেন উন্নয়ন করতে। উন্নয়নের পাশাপাশি উৎপাদনের দিকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন, দেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। তাই তিনি গ্রামে বিদ্যুৎ, রাস্তা, স্বাস্থ্যসেবা, সেচ সবই পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিটি ছেলেমেয়ে শিক্ষিত হবে, প্রতিটি কৃষক স্বাবলম্বী হবে, প্রতিটি যুবক উদ্যোক্তা হবে। তিনি শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ালেন, কৃষি ঋণ সহজ করলেন, মাঠে ঘাটে প্রান্তরে ঘুরে তিনি নিজ হাতে খাল কাটার সূচনা করেছিলেন। স্বনির্ভর কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পোদ্যোগকে উৎসাহিত করলেন।
তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। সুপার পাওয়ারদের মধ্যে ভারসাম্য রেখে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা কারো তাঁবেদারি করব না, আমরা কারো বিরুদ্ধে না, আমরা আমাদের পক্ষে।’ এই দৃঢ় অবস্থান বিশ্বসভায় বাংলাদেশের সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছিল। একজন সেনা কর্মকর্তা হয়েও তিনি সেনাশাসনের মোহ কাটিয়ে রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেন। তিনি গড়লেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘রাজনীতি হবে জনগণের জন্য, নেতৃত্ব হবে সেবার জন্য, শাসনের জন্য নয়।’ তিনি কাউকে লোভ দেখিয়ে কাছে টানেননি, আদর্শ দিয়ে কাছে টেনেছেন। তিনি জোরে কথা বলতেন না, তাঁর কাজই জোরে কথা বলত। একজন কৃষক, একজন ছাত্র, একজন রাজনৈতিক কর্মী সবাই তাঁর মধ্যে একজন ভরসার মানুষ খুঁজে পেয়েছিল।
শহীদ জিয়াউর রহমান আমাদের দেখিয়েছিলেন একটি স্বাধীন, আত্মনির্ভরশীল, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রের স্বপ্ন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার একজন অতন্দ্র প্রহরী। আজ তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর আদর্শই আমাদের স্বপ্নপূরণের অনুপ্রেরণা।
লেখক : রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক
প্যানেল