ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাংলাদেশে জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের সমীকরণ

অর্ঘ্য প্রতীক চৌধুরী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস

প্রকাশিত: ০২:২০, ৩১ মে ২০২৫

বাংলাদেশে জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের সমীকরণ

বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা আর জলবায়ু সংকটের দ্বৈত চাপে নিষ্পেষিত। টেকসই জ্বালানির খোঁজে জলবিদ্যুত আলোচনায় এলেও, এর বাস্তবায়ন জটিল এক পথরেখা ভূপ্রকৃতি, পরিবেশগত প্রভাব আর জলবায়ু ঝুঁকির বেড়াজালে আবদ্ধ।

কাপ্তাই বাঁধ: 
বাংলাদেশের জলবিদ্যুতের গল্প শুরু কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে (রাঙ্গামাটি, ১৯৬২)। এর ২৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতা জাতীয় গ্রিডে মাত্র ০.৯% বিদ্যুৎ যোগায় (পিডিবি, ২০২৩), যেখানে নেপাল-ভুটানে ৯০% বিদ্যুতই আসে জলবিদ্যুৎ থেকে! দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করলেও, পলি জমে এর দক্ষতা দিন দিন কমেছে। এর সবচেয়ে করুণ ইতিহাস হলো প্রায় ১ লক্ষ আদিবাসী চাকমা মানুষের বাস্তুচ্যুতি, যা আজও এক গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষত (আইইউসিএন, ২০২২)।

ভূপ্রকৃতি: আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?

পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী নদী সহ – বাংলাদেশে জলবিদ্যুতের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অঞ্চল। খাড়া ঢাল আর শক্তিশালী স্রোত (কর্ণফুলীর সর্বোচ্চ প্রবাহ ২,১৫০ ঘনমিটার/সেকেন্ড) দিয়ে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব (বিপিডিবি, ২০২২)। কিন্তু দেশের প্রধান নদী পদ্মা, যমুনা, মেঘনা বহমান সমতল ভূমিতে, যার ঢাল মাত্র ০.১ মিটার প্রতি কিলোমিটার (আইডব্লিউআরএ, ২০২০)। এখানে বিশাল বাঁধ নির্মাণ তাই প্রায় অসম্ভব।

অর্থনীতির : 
দীর্ঘমেয়াদে জলবিদ্যুৎ সাশ্রয়ী (উৎপাদন খরচ প্রতি ইউনিট $০.০৫–$০.০৭) যা জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে কম। কিন্তু শুরুর দিকের বিনিয়োগ অত্যন্ত বেশি। শুধু কাপ্তাই আধুনিকীকরণেই লাগতে পারে ৫০ কোটি ডলার  (বিশ্ব ব্যাংক, ২০২০) ছোট প্রকল্পের ক্ষেত্রেও প্রতি কিলোওয়াটে খরচ $১,৮০০–$২,০০০(আইইএ, ২০২৩)। বিপরীতে, সৌরবিদ্যুতের খরচ প্রতি মেগাওয়াটে মাত্র ১২ লক্ষ ডলার (সরেদা, ২০২৩)। উপরন্তু, বছরে ১৮০ কোটি টন পলি (বাপাউবো, ২০২১) বাঁধের কার্যকারিতা কমায়, ড্রেজিংয়ের খরচ বাড়ায় এবং আয়ু কমিয়ে দেয়।

পরিবেশ বনাম সমাজ 
জলবিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য হলেও এর পরোক্ষ জলবায়ু প্রভাব  উদ্বেগজনক। জলাধারে জমা জৈববস্তু পচে মিথেন গ্যাস নির্গত করে – যা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ২৮ গুণ বেশি ক্ষতিকর (আইপিসিসি, ২০২১)! কর্ণফুলীর প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে ইলিশ সহ ১২টি মাছের প্রজাতি বিলুপ্তির পথে (আইইউসিএন, ২০২২)। সামাজিক দিক থেকে, কাপ্তাইয়ের মতো প্রকল্পে 

পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের অভাব স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত রেখেছে। নেপালের মিডল মার্স্যাংদি প্রকল্প, যেখানে সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছিল, তা বাংলাদেশের জন্য একটি উত্তম দৃষ্টান্ত হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি 
অনিয়মিত মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও হিমালয়ের হিমবাহ গলে যাওয়া নদীর প্রবাহে অনিশ্চিয়তা তৈরি করেছে। ২০৫০ সাল নাগাদ কর্ণফুলীর প্রবাহ ১৫-২০% কমে গেলে কাপ্তাইয়ের বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসতে পারে (বিশ্ব ব্যাংক, ২০২২)। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দরকার টেকসই সমাধান – যেমন সামঞ্জস্যযোগ্য টারবাইন এবং সৌর বা বায়ুর সাথে জলবিদ্যুতের সংকর (হাইব্রিড) জ্বালানি ব্যবস্থা।

ছোট প্রকল্প ও সংকর জ্বালানির সম্ভাবনা:
বাংলাদেশে জলবিদ্যুতের ভবিষ্যৎ হয়তো  ক্ষুদ্র (৫০ কিলোওয়াট–১০ মেগাওয়াট) প্রকল্পের হাত ধরে। সিকলদার খালে ৭ মেগাওয়াটের প্রকল্প (পিডিবি, ২০২৪) তারই নমুনা। জলবিদ্যুতের সাথে সৌরশক্তির মেলবন্ধন চমৎকার সমাধান হতে পারে – বর্ষায় জলবিদ্যুৎ, শুকনো মৌসুমে সৌরবিদ্যুৎ। ভুটানের সাফল্য (তাদের উৎপাদনের ৭০% বিদেশে রপ্তানি, আহমেদ ও অন্যান্য, ২০২৩) আঞ্চলিক জ্বালানি সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

অগ্রযাত্রার পথ: 
ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু সংকটের কারণে বাংলাদেশে বৃহদায়তন জলবিদ্যুৎ সম্প্রসারণ চ্যালেঞ্জিং। তবে ছোট ছোট প্রকল্প, সংকর জ্বালানি পদ্ধতি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা, তে বিনিয়োগ টেকসই জ্বালানি ভবিষ্যৎ গড়তে পারে। এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ :

কঠোর পরিবেশগত সমীক্ষা: প্রকল্পের আগে-পরে প্রভাব মূল্যায়ন।
সক্রিয় সম্প্রদায় অংশগ্রহণ: স্থানীয় জনগণের মতামত, ক্ষতিপূরণ ও সুবিধা নিশ্চিত করা।
সবুজ অর্থায়ন: পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে বিনিয়োগে উৎসাহ।

জলবিদ্যুৎ একা বাংলাদেশের জ্বালানি সংকটের সমাধান নয় । কিন্তু সৌর, বায়ু ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎসের সাথে এটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখতে পারে – জনগণ ও প্রকৃতির ক্ষতি না করে একটি টেকসই ভবিষ্যতের পথে।

রাজু

×