
ছবি: সংগৃহীত
দশকের পর দশক ধরে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন ব্রহ্মাণ্ডে সোনাসহ ভারী উপাদানের উৎস কোথায়। এবার নতুন একটি গবেষণা পুরনো মহাকাশ মিশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি সম্ভাব্য সূত্র পেয়েছে— ম্যাগনেটার (এক ধরনের নিউট্রন তারা যাদের চৌম্বক ক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী)।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হওয়ার প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাংয়ের পর হাইড্রোজেন, হিলিয়ামসহ কিছু হালকা উপাদান তৈরি হয়েছিল। এরপর বিস্ফোরিত তারাগুলো থেকে লোহা জাতীয় ভারী উপাদান ছড়িয়ে পড়ে, যা নবীন নক্ষত্র ও গ্রহ গঠনে যুক্ত হয়। কিন্তু সোনার মতো আরও ভারী উপাদানের ছড়ানো রহস্য হয়ে আছে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের জন্য।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ডক্টরাল ছাত্র অনিরুধ পাটেল, যিনি এই গবেষণার গবেষকদলের প্রধান, বলেছেন, ‘এটি মহাবিশ্বে জটিল পদার্থের উৎপত্তি নিয়ে একটি মজার ও গভীর ধাঁধা যা এখনো সমাধান হয়নি।’
কেবল নিউট্রন তারার সংঘর্ষ নয়, ম্যাগনেটারও সোনার উৎস?
আগে ধারণা করা হতো, মহাকাশে সোনার উৎপত্তি মূলত নিউট্রন তারার সংঘর্ষ থেকে। ২০১৭ সালে দুই নিউট্রন তারার সংঘর্ষে গড়ে ওঠা কিলোনোভা নামের মহাজাগতিক বিস্ফোরণে প্রচুর সোনা, প্লাটিনাম ও সীসা তৈরি হয়েছিল। এই ঘটনাকে মহাকাশের ‘সোনা ফ্যাক্টরি’ বলা হয়।
কিন্তু লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক এরিক বার্নস বলেন, ‘নিউট্রন তারার সংঘর্ষ বেশিরভাগই ঘটে এসেছে সাম্প্রতিক কয়েক বিলিয়ন বছরে, কিন্তু NASA ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ২০ বছর আগের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে ম্যাগনেটারের বিকিরণ আরেকটি সম্ভাব্য সোনা উৎপাদন প্রক্রিয়া।’
ম্যাগনেটার এবং তার ‘স্টারকোয়েক’
নিউট্রন তারাগুলো হলো বিস্ফোরিত তারার অবশিষ্টাংশ। এক চা চামচ তারার পদার্থ পৃথিবীতে ১০০ কোটি টন ওজনের সমান। ম্যাগনেটার হলো এই নিউট্রন তারাদের একটি বিশেষ প্রকার, যার চুম্বক ক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী।
ম্যাগনেটারগুলো মাঝে মাঝে ‘স্টারকোয়েক’ বা তারার ভূমিকম্পের মাধ্যমে একপ্রকার শক্তিশালী বিকিরণ মুক্ত করে। পৃথিবীতে যেমন ভূমিকম্প হয় মাটির টেকটনিক স্তরের চাপ জমার কারণে, তেমনই ম্যাগনেটারের গাঢ় এবং তরল ভেতরের চাপ জমে স্টারকোয়েক সৃষ্টি করে। এই সময় তারা একদম ছোট ছোট সময়ের মধ্যে একধরনের এক্স-রে ফ্লেয়ার ফেলা শুরু করে।
মহাবিশ্বের প্রাচীনতম ম্যাগনেটারের রহস্যময় সিগন্যাল
গবেষকরা জানতে চেয়েছিলেন, ম্যাগনেটারের বিকিরণ এবং ভারী উপাদানের উৎপত্তির মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে কি না। তারা দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন দৃশ্যমান ও অতিবেগুনি আলোসহ গামা রশ্মিতে। তবে বার্নস গামা রশ্মির ওপর নজর দিলেন।
২০০৪ সালে মহাকাশে ঘটে যাওয়া এক বৃহৎ ম্যাগনেটার ফ্লেয়ারের গামা রশ্মির তথ্য NASA ও ESA-র মহাকাশ যন্ত্র INTEGRAL থেকে পাওয়া যায়। এই সিগন্যাল তখন বোঝা যেত না, কিন্তু এখনকার মডেলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, ম্যাগনেটারের বিকিরণ এবং ভারী ধাতু উৎপাদনের পূর্বাভাস ওই তথ্যের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।
সোনার উৎপত্তির বিকল্প পথ?
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রায়ান মেটজগার ও তার গবেষকদলের ধারণা, ম্যাগনেটারের ফ্লেয়ারগুলো তারার বাইরের আবরণ গরম করে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে দেয়, যা ভারী উপাদানের সৃষ্টির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে।
তবে গবেষণায় সরাসরি প্রমাণ না থাকায় কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি সোনার উৎপত্তির একটি সম্ভাব্য বিকল্প পথ মাত্র। রোমের ইউনিভার্সিটির ড. এলিওনোরা ট্রোজা বলেছেন, ‘ম্যাগনেটারগুলো খুবই জটিল বস্তু, এবং সোনা তৈরির জন্য যেসব শর্ত দরকার সেগুলো সব সময় হয় না। তাই নতুন কোনও সোনার উৎস আবিষ্কৃত হয়েছে বলাটা ঠিক হবে না।’
তবে গবেষকরা মনে করেন, ম্যাগনেটারের জায়ান্ট ফ্লেয়ারগুলো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে লোহার চেয়ে ভারী উপাদানের প্রায় ১০% উৎপাদনের জন্য দায়ী হতে পারে।
ভবিষ্যতের গবেষণার পথ
২০২৭ সালে NASA-এর ‘Compton Spectrometer and Imager (COSI)’ মিশন ম্যাগনেটারের ফ্লেয়ার পর্যবেক্ষণ করবে এবং ভারী উপাদান শনাক্ত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বে সোনাসহ অন্যান্য ভারী উপাদানের উৎপত্তি স্পষ্ট হবে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন।
রাকিব