
(গত শুক্রবারের পর)
লিসানুল আরব গ্রন্থের ৮/১৭৫-১৭৭ পৃষ্ঠায় শরিয়তের আক্ষরিক পরিচয় দেওয়া হয়েছে এমন ভাবে- এটি এমন একটি প্রকাশ্য পথ, যে পথে পানির কাছে পৌঁছানো যায় এবং এমন একটি পানির ঝর্ণা যেটা মানুষ তৈরি করেছে। অর্থাৎ সে পানি তাদের দিকে নেমে আসে এবং তারা তা থেকে পান করে এবং পরিতৃপ্ত হয়। আরবরা এ স্থানটিকে ততক্ষণ শরিয়ত বলে না, যতক্ষণ না তা অবিরত ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে এবং প্রকাশ্য ও নির্দিষ্ট থাকে, রশি দিয়ে বালতি নামিয়ে তা থেকে পান করতে হয় না। শরিয়ত শব্দটি গৃহীত হয়েছে ‘তাশরী’ থেকে। এ হচ্ছে উটের রীতি বর্ণনা করা। অর্থাৎ উট হাউজে পানি পান করে না এবং পানি বের করে এনে দৃঢ়ভাবে তার সামনে ধরতে হবে, তবে যে সে পান করবে, এরও সে মুখাপেক্ষী নয়। কথায় বলে ‘তাশরী’ হচ্ছে অতি সহজে পানি পান করা।
শরিয়তের পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে- কার্যকর অনুশাসন ও বিধি। সম্ভবত শরিয়ত বিশারদগণ এটি গ্রহণ করেছেন আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী থেকে: ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি তৈরি করেছি শরিয়ত ও পথ। তারপর আমি তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি শরিয়তের বিশেষ বিধানের ওপর।’
কাতাদাহ বলেন- ‘শরিয়ত হচ্ছে, আদেশ-নিষেধ এবং হুদুদ (শাস্তি) ও ফরজসংক্রান্ত বিধান। কারণ, শরিয়ত একটি পথ, যা সত্যের দিকে চলে।’
ইবনে আছির তার নিহায়াহ গ্রন্থে বলেছেন- ‘শরিয়ত হলো, আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত সেই বিধান, যা বান্দার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। জীবনে চলার পথের যাবতীয় প্রয়োজনের সমাধান দেওয়া হয়েছে, এর মাধ্যমেই একজন মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে কল্যাণকামী হবেন।’ আর আল্লাহ দীন বিধিবদ্ধ করেছেন শরিয়ত হিসেবে, যেহেতু তিনি তাকে প্রকাশ করেছেন ও সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন।
এর ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি- শরিয়ত বলতে দীন বুঝায়, যা রাসুলগণ আল্লাহর নিকট থেকে এনেছেন মানুষকে সত্যের পথ প্রদর্শন করার জন্য আকিদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এবং কল্যাণ ও ন্যায়ের পথ প্রদর্শন করার জন্য আচার-আচরণ ও লেনদেনের ক্ষেত্রে। আর এ অর্থেই শরিয়ত শব্দটি বিশ্বাস ও কর্ম উভয় দিকেই প্রসারিত। এ দুটিই সম্মিলিতভাবে দীনে কামেল তথা পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। তবে ফকিহগণের ভাষায় শরিয়ত কেবল ব্যবহারিক বিধিবিধানকেই বুঝায়।
কেউ কেউ এর সংজ্ঞা এভাবে নির্দেশ করেছেন- শরিয়ত এমন বিধিবিধানকে বুঝায়, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যার প্রচলন করেছেন, যাকে জীবনে কার্যকর করে তারা দুনিয়ায় ও আখিরাতে সফলকাম হতে পারে। আর আল্লাহ দীন প্রচলন করেছেন অর্থাৎ তা প্রণয়ন করেছেন। এটি আল্লাহর কাছ থেকে নাজিল হয়েছে। যেমন- আল্লাহ বলেন: ‘তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন, যার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে। আল্লাহ ছাড়া আর কারোর শরিয়ত প্রণয়ন করার অধিকার নেই।’ এ আয়াতটি একথা প্রমাণ করে যে, মানুষের জন্য দীনের বিধান প্রণয়ন করা এবং তাকে শরিয়ত নামে অভিহিত করা মূলত শরিয়ত শব্দটির ধাতুগত অর্থই প্রকাশ করেছে। শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থের মধ্যে কি সম্পর্ক থাকে?
ইতোপূর্বে আমরা জেনেছি, শরিয়তের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- পানির উৎস বা এমন পথ যা পানির কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। আর পারিভাষিক অর্থে এটি হচ্ছে মানুষকে পথ দেখানোর। আর শরিয়ত হলো এমন সব বিধান, যেগুলো আল্লাহর হুকুম থেকে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি যা আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। শরিয়তের কতিপয় বিধানের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলেও তার সমাধান রয়েছে স্থান কাল পাত্রভেদে, এর মাধ্যমেই সমগ্র দীনি ব্যবস্থার মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
কুরআনের কতিপয় আয়াতে নবী-রাসুলগণের অভিন্ন পথের কথা বলা হয়েছে। আবার কতিপয় আয়াতে বলা হয়েছে তাদের ভিন্নতার কথা। এ আয়াতগুলোর মধ্যে সমন্বয় হবে কী করে? প্রথম ধরনের বিষয় সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতে বলা হয়েছে- ‘তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত করো। তার মধ্যে মতভেদ করো না’
‘তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছিলেন, কাজেই তাদের পথ অনুসরণ করো। (সুরা আশশুরা, ১৩ আয়াত)।
আবার দ্বিতীয় ধরনের আয়াতে বলা হয়েছে:
‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরিয়ত ও স্পষ্ট পথ তৈরি করে দিয়েছি।’
‘তারপর আমি তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দীনের বিশেষ বিধানের ওপর, কাজেই তুমি তার অনুসরণ করো। (আল মায়েদা, আয়াত-৪৮)।
এ উভয় ধরনের বক্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পদ্ধতি হচ্ছে- যেমন বলা হয়, প্রথম ধরনের আয়াতগুলো দীনের মূলনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং দ্বিতীয় ধরনের আয়াতগুলো দীনের শাখা-প্রশাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ইমাম কুরতুবী বলেন, ‘দীন প্রতিষ্ঠিত করো’ এ বিষয়টি হচ্ছে- আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস ও তাঁর আনুগত্য করা। তাঁর রাসুলগণও কিতাবের প্রতি, পরকালের প্রতি এবং এক ব্যক্তির মুসলমান থাকার জন্য যা কিছুর প্রয়োজন, সেসবের প্রতি ইমান রাখা এবং মুসলিম উম্মতের কল্যাণার্থে নিবেদিত শরিয়তকে প্রত্যাখ্যান না করা। শরিয়ত বিভিন্ন এবং তাদের মধ্যে দূরত্বও রয়েছে। (সূত্রঃ আল কুরতুবী, ১৬ খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ১০-১১)।
আল্লাহ প্রদত্ত নবী-রাসুলদের ওপর নাজিলকৃত বিধান প্রায়ই অভিন্ন ছিল। ‘হে মুহাম্মদ ও নূহ! তোমাদের আমি একই দীন তথা জীবন বিধান মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছি- তোমাদের এমন মূলনীতি মেনে চলতে হবে, যার শরিয়ত ভিন্ন হবে না। সেই শরিয়ত হচ্ছে- তাওহীদ, নামাজ, জাকাত, রোজা, হজ, সৎকর্মশীলতা সহকারে আল্লাহর নৈকট্য, সত্যবাদিতা, অঙ্গীকার পালন, আমানতদারি, আত্মীয়দের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, কুফরী না করা, হত্যা না করা, যিনা না করা, আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট না দেওয়া, যথেচ্ছ অর্থ ব্যয় না করা, জীবের প্রতি অত্যাচার না করা, হীনতাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া এবং সৌজন্যবোধ খতম না করা। এসবই একটি দীন ও ঐক্যবদ্ধ মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি জনপদের নাগরিকগণ যদি আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়তের বিধানাবলি নিষ্ঠার সঙ্গে পরিপালন করেন, তবে জাগতিক জীবনে শান্তির ফল্গুধারা বয়ে যাবে।
(সমাপ্ত)
লেখক : সাংবাদিক
প্যানেল