ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আরাফার দিন: করুণা আর ক্ষমার আকাশভাঙা ধারা

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

প্রকাশিত: ০২:৩৯, ৩১ মে ২০২৫

আরাফার দিন: করুণা আর ক্ষমার আকাশভাঙা ধারা

পৃথিবীর বুকে কিছু কিছু দিন আছে, যেগুলোর ওজন সময়ের কাঁধ ছাপিয়ে আখিরাত পর্যন্ত পৌঁছায়। এমনই একটি দিন হলো আরাফাত। এক দিকে হাজারো সাদা কাপড়ে মোড়ানো আত্মার কান্না ভেসে ওঠে আরাফাতের প্রান্তরে, অন্যদিকে আসমান থেকে নেমে আসে রহমতের অবিরাম ধারা। মানুষ, ফেরেশতা আর তার প্রভুর মধ্যে এক অপার সম্মিলনের নাম—এই মহান দিনটি।

আরাফার দিনের মাহাত্ম্য শুধু হজের আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং এটি ইসলামের ইতিহাসে একটি অলৌকিক দিন, যে দিনে ধর্মের পূর্ণতা ঘোষিত হয়েছিল কিয়ামতের পূর্বাভাসস্বরূপ এক মহান সমাবেশে। সূরা মায়িদার ঐতিহাসিক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন—“আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পন্ন করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য জীবনব্যবস্থা হিসেবে পছন্দ করলাম।” এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল আরাফাতের দিন, আরাফার ময়দানে, মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের সময়। সে দিনটি ছিল শুক্রবার, আর সে মুহূর্তটি ছিল মানবজাতির জন্য এক ঐশী ঘোষণা।

এই দিনটির প্রতি আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা এত গভীর যে, হাদীসে বলা হয়েছে—এ দিন তিনি ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করেন তাঁর বান্দাদের নিয়ে। আরাফাতের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লাখো মুখ, যাদের চোখে অশ্রু আর অন্তরে তওবা—তাদের প্রতি আল্লাহর ঘোষণা হয়, “তোমরা চলে যাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম।” এই দিন জাহান্নামের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, আর জান্নাতের দরজা খোলে ধারে ও বাহারে।

আরাফার প্রান্তর যেন হাশরের মাঠের এক প্রতীক। সেখানে নেই ধনী-গরিবের ভেদাভেদ, নেই রাজা-প্রজার শ্রেণিবিভাগ। সবাই এক পোশাকে, এক অবস্থায়, এক চাওয়া নিয়ে প্রভুর সামনে দাঁড়িয়ে। এই অবস্থান মানুষকে শেখায় বিনয়, আত্মসমর্পণ, আত্মশুদ্ধি। শেখায়, মানুষের প্রকৃত পরিচয় তার চোখের পানিতে, তার কণ্ঠের দোয়া আর তার অন্তরের আকুলতায়।

যারা হজে যেতে পারেননি, তাদের জন্যও এই দিন এক মহা উপহার। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বাণী অনুযায়ী—এই দিনের রোজা একটি অতীত বছরের ও একটি আগত বছরের গোনাহ মোচনের কারণ হয়। আল্লাহর কী অপার অনুগ্রহ! একটি মাত্র দিনের সংযম, একটি অন্তর থেকে উচ্চারিত মিনতি—মানবজীবনের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়কেও আলোকোজ্জ্বল করতে পারে।

আরাফার দিন এক প্রার্থনাময় অধ্যায়। এই দিন বান্দা দোয়া করে, হৃদয় খুলে বলে তার যাবতীয় কষ্ট, গোপন আকাঙ্ক্ষা, ব্যর্থতা, অনুশোচনা। আর আল্লাহ তা শোনেন মনোযোগে। রাসূল (সা.) বলেন—“আরাফার দিনের দোয়া, তা-ই সর্বোত্তম দোয়া।” এই দিনে বান্দা তাঁর রবের এতটাই কাছাকাছি থাকে যে, কোনো পর্দা থাকে না তাদের মাঝে। সে এক অনির্বচনীয় মুহূর্ত—যেখানে মানুষ একেবারে নগ্ন আত্মা নিয়ে দাঁড়ায় তাঁর প্রভুর দরজায়, কাঁদে, মিনতি করে, এবং ফিরে পায় নতুন এক পরিচয়।

এই দিন হলো মানুষ হয়ে ওঠার দিন। যেদিন মানুষ বুঝতে পারে—তার আসল শক্তি তার কান্নায়, তার নত হওয়ার সাহসে, তার পাপ স্বীকার করার সদিচ্ছায়। যারা এই দিনে একবারও সত্যিকারের ক্ষমা চায়, তাদের জীবনের পালা ঘুরে যেতে পারে। তওবার দরজা যেমন সব সময় খোলা, তেমনি এই দিনে সেই দরজা হয় সবচেয়ে প্রশস্ত।

আরাফার দিন আমাদের শেখায়, আল্লাহ কতটা করুণাময়। তিনি চান না কেউ ধ্বংস হোক। বরং তিনি চান, তার বান্দা ফিরে আসুক, কান্না করুক, তওবা করুক, নতুনভাবে জীবন শুরু করুক। এই দিন তাই কেবল অতীত নয়, এটি ভবিষ্যতের এক আলোকবর্তিকা।

এটি এমন এক মুহূর্ত, যখন সময় স্থির হয়ে দাঁড়ায়, আকাশ নত হয়, মাটি শুদ্ধ হয়, আর হৃদয় পায় নতুন জন্মের ঘোষণা।

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো,মিশর

রাজু

×