
তাপসী আছিয়া সহ এ সময় নির্যাতিত নিষ্পেষিত ও হয়রানীর শিকার দেশ প্রেমিক মানুষগুলোকে উৎসর্গ করে এ লিখনি অবতারণা করছি। ভালোবাসা যেভাবে মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহস জোগায়, তেমনি ভালোবাসা মানুষকে প্রাণ বিসর্জন দিতেও সাহসী করে তোলে। ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্রসংগ্রাম করে লাখ লাখ মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ আমরা পেয়েছি, তার মূলেও আছে মুক্তিকামী জনতার দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ। স্বাধীনতা আল্লাহর দেওয়া বড় নিয়ামত। মাতৃভূমির প্রতি হৃদয়ের টান এক মহান মানবীয় গুণ। মাতৃভূমির প্রতি যে বিশেষ অনুরাগ-আবেগ, মমতা ও ভালোবাসা, তারই নাম দেশপ্রেম। ইসলামে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার জোরালো দিকনির্দেশ রয়েছে। দেশপ্রেম ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসা এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ইমানের দাবি। তাই বহুল প্রচারিত আরবি প্রবাদ- ‘স্বদেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’ ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়জুড়ে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। এ গুণের অধিকারী ছিলেন মানবতার মুক্তির অগ্রদূত সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম। তাঁরা দেশ ও সমাজের উপকার করে স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁদের দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদেরও সেসব দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা উচিত।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা কেমন ছিল, তা সুস্পষ্টরূপে ফুটে ওঠে হিজরতের প্রাক্কালে মক্কাকে লক্ষ্য করে দেওয়া তাঁর ভাষণে। মদিনায় হিজরতের প্রাক্কালে রাসুলে পাক (সা.) বলেছিলেন, ‘আল্লাহর নামে শপথ-হে মক্কা, তুমি আল্লাহর ভূখণ্ডগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম, তুমি আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় তার অন্যান্য ভূখণ্ড থেকে। আমি যদি তোমার কোল থেকে বহিস্কৃত না হতাম, আমি তোমার কাছ থেকে বের হয়ে যেতাম না।’
যুগে যুগে দেশপ্রেমিকগণ জগতের ইতিহাসে তাদের কর্মময় জীবনের মহান দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ দেশের কল্যাণে তাদের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, লেনিন, মাওসেতুং, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ নেতা দেশকে ভালোবেসে দীর্ঘকাল কারাবরণ করেছেন। অত্যাচার আর পীড়ন সহ্য করে দেশ ও জাতির মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্বদান করেছেন। কোনো ভয়, প্রলোভন তাঁদেরকে কাবু করতে পারেনি। তাই তো বিশ্বের ইতিহাসে এসব মহান দেশপ্রেমিকের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানপ্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ দেশের জনগণ মায়ের মতো দেশমাতৃকারপ্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করেছে। ৫২, ৫৪, ৬৬, ৬৯ সালে রক্ত দিয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত হয়ে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ, এ মাটিকে শত্রুমুক্ত করেছে শুধু স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়েছিল বলে। দেশ সৃষ্টির এরূপ দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর নতুন শোষণের মুখে পড়ে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিরা। এর বিরুদ্ধেপ্রতিবাদ শুরু হলে ফুঁসে ওঠে পুরো জাতি, স্বাধিকার চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালে দায়ের করা হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। ৬৯-এর নির্বাচনে পুরো পকিস্তানে জয়লাভ করার পরও সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি বঙ্গবন্ধুকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে ‘মহান দেশপ্রেমিক’ হিসেবে চিরদিনের জন্য পাকাপোক্ত অবস্থান করে নেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু ‘মহান দেশপ্রেমিক’ হয়ে ওঠার বিষয়টি তার এককালের ঘোরতর শত্রুরাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। বিষয়টি উঠে এসেছে একাত্তরে বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেওয়া পাকিস্তানের (বেলুচিস্তান) সাবেক অফিসার মেজর জেনারেল তোজাম্মেল হোসেন মালিকের স্মৃতিকথায়। তিনি লিখেছেন, ‘বস্তুত মুজিব দেশদ্রোহী ছিলেন না (পাকিস্তানে তাকে সেভাবে চিত্রিত করা হলেও)। নিজ জনগণের জন্য তিনি ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক।’ কেবল মালিকই নন; তৎকালীন পাকিস্তানি জান্তার মুখপাত্র মেজর সিদ্দিক সালিকও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। এ সমাজ আবার কতকগুলো ধর্ম, ভাষা, নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমায় বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে স্বতন্ত্র বা পৃথক রাষ্ট্র, জাতি বা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে থাকে। এ স্বাতন্ত্র্যবোধ তীব্র হয়ে যখন অঞ্চলবিশেষের মানুষের মধ্যে একটি ঐক্যচেতনা জাগিয়ে তোলে, তখনই তার নাম হয় দেশাত্মবোধ, স্বাজাত্যবোধ বা স্বদেশপ্রেম। মূলত স্বদেশপ্রেমের উদ্ভব আত্মসম্মান বোধ থেকে। এ জন্যই বলা হয়ে থাকে, যে জাতির আত্মসম্মানবোধ যত বেশি, সে জাতির স্বদেশপ্রেম তত বেশি। স্বদেশপ্রেম হলো স্বর্গীয় ভাবাবেগ, আর যে দেশ প্রেমের মধ্যে কোনো স্বার্থ নেই, হিংসা নেই, সেই দেশপ্রেমই হলো স্বদেশপ্রেম।
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে-
কে বাঁচিতে চায় ?
‘দাসত্ব শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায় ?
সাম্প্রতিক সময়ে বিবেকের তাড়নায় আমাদের দেশপ্রেমের বড্ড অবাকজনিত কারণে নজির বিহীন ভয়ংকর কিছু ঘটনা তুলে ধরতে ইচ্ছে করছে। যেমন- প্রকাশ্য দিবালোকে থানায় আক্রমণ করে কয়েক শ’ পুলিশকে হত্যা করা হলেও পুলিশ হত্যার বিচার অদ্যাবধি করা হয়নি। পুলিশ কি মানুষ না? প্রকাশ্য দিবালোকে উচ্চ আদালতে মব সৃষ্টি করে অগণিত বিচারক ও বিচারপতিকে তাৎক্ষণিকভাবে অপসারণকরণ, পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেনি। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি নোট লিখলেন উচ্চ আদালত ভবন এবং জনগণের রাষ্ট্রীয় নথি রক্ষার্থে আমি পদত্যাগ করলাম। এভাবেই ধারাবাহিকতায় মব সৃষ্টি করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের এমন কোন অঙ্গ নেই যাকে দুর্বল করা হয়নি। ঘোষণা দিয়ে ৩২ নম্বর ধ্বংস করে দেওয়া হলো। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলতে শুনলাম রাখাইন রাজ্যে করিডোর প্রদান করা হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি গ্রুপ যাদের একমাত্র ব্যবসায়ী হলো বাংলাদেশে ইয়াবা চালান পাঠানো, তাদেরকে নাকি মানবিক তকমা দিয়ে করিডোর প্রদান করা হবে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে ব্যবসা সফল নিউমূরিং টার্মিনাল নাকি বিদেশীদেরকে প্রদান করবে। এতে নাকি আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নতি হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে যেসব সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে অধিকাংশ ব্যক্তিগণ বিদেশী নাগরিক নয়তো যৌথ নাগরিক। প্রতিটি ব্যক্তি কোন দেশের নাগরিক হলে ওই দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে বলে শপথ বাক্যে তারা স্বাক্ষর করতে হয়। অর্থাৎ এ লোকগুলি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে বিদেশীদের স্বার্থ রক্ষা করেন। এদের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রীয় অতীব সেনসিটিভ ও গোপনীয় তথ্যগুলিও বিদেশিদের কব্জায় চলে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তে বিনিময় এবং লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম এর বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা কি বৃথা গেল ? এসব দেখে আমার বলতে ইচ্ছে করছে আল্লাহ মাটি ফেটে যাক, আমি যেন মাটির নিচে ঢুকে যাই।
স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু তাদের দমিয়ে রাখতে পারে না। এর প্রমাণ আমাদের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ। বাংলার দামাল ছেলেরা দেশপ্রেমের মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী: জননী এবং জন্মভূমি আমাদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয়া জননী জন্মদাত্রী স্তন্যে-স্নেহে আমাদের লালন-পালন করে। আর জন্মভূমি আমাদের সবাইকে শস্যে, ফলে, অন্নে ও পানীয়ে পুষ্ট করে তোলে। তাই সে আমাদের জননী কবি গেয়ে ওঠেন, ‘তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে, তুমি শীতল জলে জুড়াইলে, তুমি যে সকল সহা সকল বহা মাতার মাতা।’ সতেরো শতকের কবি আব্দুল হাকিম তাঁর ‘নূরনামা’ কাব্যে ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় দেশেরপ্রতি গভীর উপলব্ধি ও বিশ্বাসের কথা নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেছেন। তিনি যাদের স্বদেশেরপ্রতি অনীহা, তাদের ধিক্কার দিয়েছেন, ‘যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ অর্থাৎ বঙ্গবিদ্বেষীদের তিনি জারজ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় স্বপ্নময়, স্মৃতিময় এ দেশের রূপে বিমোহিত হয়ে গেয়েছেন, ‘ধনধান্যে পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’ কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলাদেশকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে গেয়েছেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ দেশাত্মবোধ ও স্বদেশেরপ্রতি মমতা অনেক অন্যায় ও অপরাধ প্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে। তাই দেশেরপ্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতে হলে অবশ্যইপ্রত্যেক নাগরিকের অন্তরে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। স্বদেশেরপ্রতি অনুগত থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশমাতৃকাকে ভালোবাসা সবার ইমানি দায়িত্ব ও পবিত্র কর্তব্য।
আমরা দেশমাতৃকাকে ভালোবাসার শপথ গ্রহণ করি।
মুমু