ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩০ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কুরবানির ছুরিতে কাঁপুক অন্তঃকর্ণ, জেগে উঠুক ঈমানের আলো

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

প্রকাশিত: ২২:০৬, ২৮ মে ২০২৫

কুরবানির ছুরিতে কাঁপুক অন্তঃকর্ণ, জেগে উঠুক ঈমানের আলো

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান,লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর

মানুষের জীবন কখনো কখনো একটি মুহূর্তেই চিরকালীন হয়ে ওঠে। একটি আত্মত্যাগ, একটি নীরব সম্মতি, একটি ছুরির অগ্রভাগ—সব মিলে সৃষ্টি হয় এমন এক আলেখ্য, যার প্রজ্ঞা কেবল ইতিহাস নয়, বরং হৃদয়কে আলোড়িত করে। কুরবানির উৎসব ঠিক এমনই—বাহ্যিক নয়, অভ্যন্তরীণ। পশু নয়, এখানে জবাই হয় আত্মমোহ, স্বার্থপরতা ও অহংকারের অন্তর্গত পশু।

কুরবানি একটি উৎসব—তবে কেবল আনন্দের নয়, ত্যাগের। এটি শুধুমাত্র উৎসবের দিনে জবাইকৃত পশুর নাম নয়, বরং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে আত্মবিসর্জনের প্রস্তুতির নাম। কুরআনের ভাষায় কুরবানির মূল উদ্দেশ্য স্পষ্ট: “আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তোমাদের গোশত বা রক্ত; পৌঁছে যায় কেবল তোমাদের তাকওয়া।” তাকওয়াই এখানে মূল চরিত্র, বাকি সব উপাদান দৃশ্যপটে অভিনয় মাত্র।

হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন ছুরির নিচে শুইয়ে দিলেন তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে, তখন তা ছিল না কেবল পিতার পরীক্ষা। এটি ছিল ভালোবাসা আর আনুগত্যের এমন এক সংলাপ, যা কোনো ভাষায় বন্দী হয় না, কেবল ঈমানের গভীরে তরঙ্গ তোলে। ছুরি চালানোর মুহূর্তে ইব্রাহিম (আ.) হয়তো জানতেন, এই আঘাতে রক্ত নয়, ইতিহাস ঝরবে।

তবে কুরবানির সৌন্দর্য তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন এর সুবাস ছড়িয়ে পড়ে সমাজের প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে। কুরবানির একটি টুকরো গোশত যখন ছিন্নমূল শিশুর হাতে পৌঁছে যায়, কোনো বিধবার চুলায় যখন সেই মাংস সেদ্ধ হয়, তখন তা কেবল খাদ্য নয়—তা হয়ে ওঠে মানবিকতার এক নিঃশব্দ বিজয়। যে ঈদ গরিবের ঘরে হাসি দিতে পারে না, সে কেবল অনুষ্ঠান হতে পারে, উৎসব নয়।

এই যে পশু কোরবানি, তা শুধু শরিয়তের বিধান নয়, বরং আত্মিক এক অভ্যাসের প্রতীক—যেখানে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা মানুষের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করার প্রেরণায় রূপ নেয়। কুরবানি তাই শুধু ছুরি চালানোর কাজ নয়, বরং তা চালিয়ে দেওয়া নিজের ভেতরের কু-প্রবৃত্তির ওপর। এই কুরবানি, যেখানে শিং বা খুরের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে অন্তরের শুদ্ধি।

কুরবানি সবার জন্য নয়। শরিয়তের দৃষ্টিতে, এটি ওয়াজিব কেবল তাদের জন্য, যারা সামর্থ্য রাখে—যাদের কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর পরও বাকি থাকে অতিরিক্ত সম্পদ। কিন্তু যারা সামর্থ্যবান নয়, তাদের জন্য কুরবানি ফরজ নয়—তবে তাদের জন্য ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না রাখার দায় রয়ে যায় ধনীদের কাঁধে। এমন এক সমাজ গঠনের নির্দেশনা এসেছে, যেখানে গরিবের হাসিই ধনীর ইবাদতকে পূর্ণ করে তোলে।

একটি ছুরি যদি কেবল পশুর গলায় চালানো হয়, আর হৃদয়ের পশুত্বকে আস্তে আস্তে পুষে রাখা হয়, তবে সে কুরবানি রেওয়াজ হয়ে থাকে, ইবাদত হয়ে ওঠে না। আসল কুরবানি তখনই ঘটে, যখন নিজের লোভ, হিংসা, রাগ এবং অহংকারকে জবাই করা যায়। যখন আল্লাহর সন্তুষ্টিকে নিজের ইচ্ছার চেয়েও বড় করে দেখা যায়। যখন নিজে পেছনে থেকে কাউকে সামনে এগিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।

আজকের এই পৃথিবী, যেখানে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক, সম্পর্কগুলো কৃত্রিম, সহমর্মিতা জড় পদার্থের মতো—সেখানে কুরবানির শিক্ষা হয়ে উঠতে পারে এক নীরব বিপ্লব। একটি উৎসবের আড়ালে ছড়িয়ে থাকা এই মর্মবাণী যদি সত্যিকার অর্থে অনুধাবন করা যায়, তবে সমাজে শুধু মাংস নয়—বণ্টিত হবে মমতা। তখন কুরবানি হবে কেবল ধর্মীয় ফরজ আদায়ের বাহানা নয়, বরং হৃদয়ের জাগরণ, বিবেকের আলোকস্তম্ভ।

এই জগতে আমরা অনেক কিছু করতে পারি, কিন্তু সত্যিকারের ত্যাগ কেবল ঈমানদাররাই পারে। কারণ তারা জানে, আল্লাহর সন্তুষ্টির কাছে দুনিয়ার কোনো কিছুই প্রিয় নয়। কুরবানির ছুরিতে তাই আজ কেটে যাক না শুধু পশু নয়, বরং গোঁড়ামি, আত্মম্ভরিতা ও স্থবিরতা। যেন এক একটি জবাই হয়ে ওঠে এক একটি মুক্তি।

সানজানা

×