ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জলবায়ুর রং লাল! আগুনে ঝলসে উঠতে পারে পৃথিবী ২.৭ ডিগ্রি উষ্ণতায়

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৩০ মে ২০২৫

জলবায়ুর রং লাল! আগুনে ঝলসে উঠতে পারে পৃথিবী ২.৭ ডিগ্রি উষ্ণতায়

ছবিঃ সংগৃহীত

জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমরা কি হেরে যাচ্ছি? প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া, পাশাপাশি ভূমি ও সমুদ্রপৃষ্ঠে তাপমাত্রার রেকর্ড ভাঙা এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনাবলির বিস্তার—সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, জলবায়ু পদক্ষেপ কি ব্যর্থতার পথে?

২০১৫ সালের শেষ দিকে, প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বনেতারা সম্মত হয়েছিলেন যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এবং সম্ভব হলে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার চেষ্টা করা হবে। প্রায় এক দশক পর, বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন এতটাই বেশি যে, ১.৫°C লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এখন প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।

তবুও, মানবতা এখন এমন এক পথে রয়েছে যা ভয়ঙ্কর জলবায়ু ভবিষ্যত এড়াতে সক্ষম হতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জ্বালানি দক্ষতা এবং অন্যান্য পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। আগের মতো বিস্তৃত কয়লা ব্যবহার, লাগামহীন নির্গমন এবং ভয়াবহ উষ্ণতার বিশ্ব এখন আর সম্ভাব্য নয়।

কীভাবে আমরা এখানে এলাম?

১৮৫০ সাল থেকে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন অব্যাহত রয়েছে। কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) সবচেয়ে বেশি নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস, পাশাপাশি মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই গ্যাসগুলো সূর্যের তাপ আটকে রাখে এবং তা মহাকাশে ফিরে যেতে বাধা দেয়।

২০২৩ সালে বিশ্বের মোট জ্বালানি-সম্পর্কিত CO₂ নির্গমনের ৪১% এসেছিল কয়লা থেকে—মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। ৩২% এসেছিল যানবাহনে ব্যবহৃত তেল পোড়ানো থেকে এবং ২১% এসেছিল গ্যাস পোড়ানোর মাধ্যমে ভবন ও শিল্পে তাপ সরবরাহ থেকে।

বিশ্ব ইতোমধ্যে এই প্রভাবের মুখোমুখি। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO) নিশ্চিত করেছে যে ২০২৪ সাল ছিল রেকর্ডকৃত ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ বছর, যেখানে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা সাময়িকভাবে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১.৫°C ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এর ফলে প্রাণঘাতী তাপপ্রবাহ, ভয়াবহ বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় দেখা দিয়েছে।

আমরা এখন কোন পথে?

২০১৪ সালে IPCC চারটি সম্ভাব্য জলবায়ু পথরেখা (RCP) তৈরি করে:

  • RCP 2.6: দ্রুত জলবায়ু পদক্ষেপ ও স্বল্প নির্গমন

  • RCP 4.5 ও RCP 6.0: কিছু পদক্ষেপ ও মধ্যম মাত্রার নির্গমন

  • RCP 8.5: কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া ও উচ্চ নির্গমন

শুধুমাত্র RCP 2.6 প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য (২°C-এর নিচে) পূরণের উপযোগী।

বর্তমানে পৃথিবী RCP 2.6 এবং RCP 4.5-এর মাঝামাঝি পথে রয়েছে, যার ফলে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ গড়পড়তা উষ্ণতা ২.৭°C হওয়ার সম্ভাবনা।

IPCC পরবর্তীতে পাঁচটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পথরেখা তৈরি করে, যেগুলোর মধ্যে বর্তমান বিশ্ব সবচেয়ে কাছাকাছি রয়েছে “মাঝামাঝি” পথে—যেখানে উন্নয়ন অসম, সম্পদ ও জ্বালানির ব্যবহার কমছে, এবং জনসংখ্যা স্থিতিশীল হচ্ছে।

এই পথরেখাগুলো এখন এক দশকের বেশি পুরোনো হওয়ায় নতুন বিশ্লেষণের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ প্রেক্ষাপটে গবেষকরা One Earth Climate Model তৈরি করেছেন, যেখানে ৪৫০ গিগাটন CO₂ নির্গমন বাজেট ধরে দ্রুত কার্বনমুক্তির পথ দেখানো হয়েছে—যা RCP 2.6 থেকেও বেশি উচ্চাভিলাষী।

বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ২৮% নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন একত্রে বিশ্বের ৫৬% ঐতিহাসিক নির্গমনের জন্য দায়ী। ১.৫°C লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এই তিনটি দেশের সম্মিলিতভাবে মাত্র ২৪৩ গিগাটন CO₂ নির্গমনের সুযোগ রয়েছে। চীনের প্রয়োজন সবচেয়ে বড় নির্গমন বাজেট।

এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জ্বালানির ১০০% নবায়নযোগ্য হতে হবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। একই সময়ের মধ্যে বন ধ্বংসও বন্ধ করতে হবে।

নির্গমন কি শিখরে পৌঁছেছে?

তবে এখনও বৈশ্বিক নির্গমন থামেনি। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন, ব্যাটারি সংরক্ষণ এবং সাশ্রয়ী দামের ইলেকট্রিক গাড়ি বাড়লেও নির্গমন বাড়ছেই।

তবে ইতিবাচক অগ্রগতি রয়েছে:

  • ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, ২০২৩ সালে তাদের নির্গমন আগের বছরের তুলনায় ৮.৩% হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯০ সালের তুলনায় ইউরোপের নিট নির্গমন ৩৭% কমেছে, যদিও এসময়ে তাদের জিডিপি ৬৮% বেড়েছে

  • অস্ট্রেলিয়ার নির্গমন গত বছর ০.৬% হ্রাস পেয়েছে এবং ২০০৫ সালের জুনের তুলনায় বর্তমানে ২৮.২% কম রয়েছে।

  • যুক্তরাষ্ট্রের নির্গমন এখনও মহামারি-পূর্ব সময়ের নিচে, ২০০৫ সালের তুলনায় প্রায় ২০% কম। ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ নির্গমন পর থেকে দেশটির নির্গমন কমছে।

  • চীন, বিশ্বের সর্ববৃহৎ নির্গমনকারী দেশ, অবশেষে নির্গমন কমাতে সক্ষম হয়েছে। ব্যাপক নবায়নযোগ্য জ্বালানির বৃদ্ধি তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্গমন হ্রাসে সহায়তা করেছে, যদিও চাহিদা বেড়েছে।

বিশ্বের মোট জ্বালানি-সম্পর্কিত CO₂ নির্গমনের ৩১% চীন থেকে আসে। তাদের নির্গমন হ্রাস বৈশ্বিকভাবে বড় প্রভাব ফেলবে।

IPCC অনুযায়ী, বৈশ্বিক নির্গমন ২০২৫ সালের আগেই শিখরে পৌঁছাতে হবে ১.৫°C সীমা ধরে রাখতে হলে। বর্তমান তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালেই এটি সম্ভব হতে পারে।

জলবায়ু রক্ষা কি এখনো সম্ভব?

যদিও প্রতিদিন নেতিবাচক খবর শোনা যায়, কিন্তু বাস্তবতা হলো—কার্বনমুক্তির ট্রেন ইতোমধ্যেই চলতে শুরু করেছে। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৯০% বৃদ্ধিই এসেছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। ইলেকট্রিক গাড়ি এখন খরচে প্রতিযোগিতামূলক, হিট পাম্প দ্রুত উন্নত হচ্ছে এবং সৌরবিদ্যুৎ ধারাবাহিকভাবে সাফল্য পাচ্ছে।

তাহলে প্রশ্ন হলো—জলবায়ু রক্ষা কি অসম্ভব হয়ে গেছে?

না। আমরা এখন যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছি তা আগের চেয়ে অনেক সস্তা এবং কার্যকর। যত দ্রুত আমরা পদক্ষেপ নেব, ততই কম বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

আমরা হয়তো ১.৫°C বা ২°C লক্ষ্যমাত্রা রাখতে পারব না, কিন্তু প্রত্যেক দশমিক ডিগ্রি উষ্ণতা কমানোই ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যত দ্রুত আমরা রূপান্তর ঘটাতে পারব, ততটাই আমাদের জলবায়ু ভবিষ্যৎ ভালো হবে।

সূত্রঃ https://theconversation.com/earth-is-heading-for-2-7-c-warming-this-century-we-may-avoid-the-worst-climate-scenarios-but-the-outlook-is-still-dire-254284

ইমরান

×