ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

টোকিওর বিভীষিকাময় আগুনের রাতের গল্প

১ লাখ মানুষের মৃত্যু এক রাতে!

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ৩০ মে ২০২৫

১ লাখ মানুষের মৃত্যু এক রাতে!

ছবিঃ সংগৃহীত

সূর্যোদয়ের দেশ বলা হয় জাপানকে। কিন্তু এই দেশে এমন এক রাত এসেছিল যার বিভীষিকার অন্ধকার আজও কাটেনি। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে টোকিওর সেই ভয়াল রাতের ইতিহাস। অথচ, টোকিওতে এক রাতের সেই হামলায় মৃত্যুর সংখ্যা হিরোশিমা-নাগাসাকির তাৎক্ষণিক প্রাণহানির চেয়েও বেশি ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ এই বোমা হামলা ইতিহাসে “অপারেশন মিটিং হাউজ” নামে পরিচিত। ১৯৪৫ সালের ৯ মার্চ, জাপানের রাজধানী এবং বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর টোকিওর আকাশে হঠাৎ গর্জে উঠল শত শত মার্কিন বি-২৯ সুপারফরট্রেস বোমারু বিমান।

ঘুমন্ত লক্ষ মানুষের অজান্তেই নামে ভয়াবহ আগুনের বৃষ্টি। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শহরের প্রায় ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ছাই হয়ে যায়। এক লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ। ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী বোমা হামলাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম, যা পারমাণবিক বোমার চেয়েও বেশি প্রাণহানি ঘটায়।

কেন এই হামলা? ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র চাইছিল জাপানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে। তবে জাপানের শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং আবহাওয়াজনিত সমস্যার কারণে উচ্চতা থেকে বোমা ফেলায় সাফল্য আসছিল না। তখন জেনারেল কার্টিস লেমে কৌশল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিচু উচ্চতা থেকে রাতের অন্ধকারে ফায়ার বোমা দিয়ে পুরো টোকিও পুড়িয়ে ফেলা হবে। জানা ছিল, টোকিওর ৯০% বাড়ি কাঠ ও কাগজের তৈরি, ফলে আগুন সহজেই ছড়িয়ে পড়বে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে জাপানি স্টাইলের একটি মডেল গ্রাম বানিয়ে পরীক্ষাও চালানো হয়। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এম৬৯ ন্যাপাম বোমা ব্যবহার করার। এই বোমাগুলোতে ছিল জেলি-যুক্ত পেট্রোল, যা মানুষের শরীর ও কাঠে আটকে গিয়ে দাবানলের মতো আগুন ছড়িয়ে দেয়।

৯ মার্চ রাত ১০টা—প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ৩৩৪টি বি-২৯ বিমান টোকিওর উদ্দেশে উড়ে যায়। রাত ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে, মাত্র ৫ থেকে ৭ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে প্রথম বোমা ফেলা হয় টোকিওর সীতামাচি এলাকায়। জনবহুল এই শহরে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ৫ লাখ ন্যাপাম ক্লাস্টার বোমা। মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখায় ঘিরে যায় শহর। প্রায় ৯০% এলাকা ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষ প্রাণ বাঁচাতে সুমিদা নদীতে ঝাঁপ দিলেও, নদীজুড়ে লাশে ভরে যায়।

সেই বিভীষিকাময় রাতের প্রত্যক্ষদর্শী হারুও নিহেই তখন মাত্র আট বছরের শিশু। তিনি পরে বলেন, “ঘুম ভেঙে দেখি চারদিকে আগুন। বাবা আমাকে কোলে তুলে দৌঁড়াচ্ছেন, আর রাস্তায় পুড়ে যাওয়া মানুষের শরীর পড়ে আছে। আকাশ থেকে পড়া ন্যাপাম আমাদের গায়েও লেগে যাচ্ছিল। মৃতদেহে ভরে গিয়েছিল পথঘাট। একসময় আমি নিজেও পড়ে যাই লাশের স্তূপের নিচে।”

টোকিও হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র আরও ৬৬টি জাপানি শহরে ন্যাপাম বোমা ফেলেছিল, যার মধ্যে ছিল ওসাকা, কোবে এবং নাগোয়া। এসব হামলার কোনও নির্দিষ্ট সামরিক লক্ষ্য ছিল না—এর উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ছড়ানো। পরে জেনারেল লেমে স্বীকার করেছিলেন, “জাপানিদের হত্যা করা আমার জন্য কোনও সমস্যা ছিল না। যদি আমরা যুদ্ধে হেরে যেতাম, আমাকে যুদ্ধাপরাধের জন্য ফাঁসি দেওয়া হতো।”

টোকিও বোমা হামলা শুধু একটি যুদ্ধের অধ্যায় নয়, এটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও নৃশংস অধ্যায়গুলোর একটি। এই হামলায় অংশ নেওয়া এক মার্কিন পাইলট পরদিন ডায়েরিতে লেখেন, “দান্তের লেখা ‘ইনফার্নো’ আমাদের কাছে শুধুই কল্পনা মনে হতো। কিন্তু টোকিওর সেই রাত ছিল ভয়াবহ বাস্তব।”

এমনও শোনা যায়, মানুষ পোড়ার গন্ধে মার্কিন বোমারুরা বিমানের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। টোকিওর সেই আগুনের রাত এখনও ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে এক নিস্তব্ধ আর্তনাদ হয়ে।

সূত্রঃ https://youtu.be/VbBS3csYCqM?si=tj0OObA4yy-mdZj2

ইমরান

×