ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর

বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব নাকি মার্কিন প্রভাব পুনরুদ্ধার

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ১৮:৩৭, ২৩ মে ২০২৫

বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব নাকি মার্কিন প্রভাব পুনরুদ্ধার

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উপসাগরীয় অঞ্চল তথা সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪ দিনের সফর করেছেন। ইসরাইলকে উপেক্ষা করেই মধ্যপ্রাচ্যে ঐতিহাসিক সফর করেছেন ট্রাম্প। এ সফরের মূল লক্ষ্য অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বাণিজ্যিক চুক্তি সই। ট্রাম্প প্রশাসনের নিকট উপসাগরীয় অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে যে গুরুত্বপূর্ণ, তা তার এ সফরের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক সময়ের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টদের প্রচলিত রীতির এটি ব্যতিক্রম। দেশটির আধুনিক কালের প্রেসিডেন্টরা প্রথম বিদেশ সফরের জন্য সাধারণত যুক্তরাজ্য, কানাডা বা মেক্সিকোকে বেছে নিতেন। ট্রাম্প এমন এক সময় এই সফর করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যখন ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছে। ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই উপসাগরীয় আরব দেশগুলো বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। হোয়াইট হাউস ট্রাম্পের এ সফরকে মধ্যপ্রাচ্যে ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন আখ্যা দিয়েছে। একইসঙ্গে স্থিতিশীলতা, সুযোগ ও পারস্পরিক সম্মানের একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ট্রাম্প ১৩ মে সৌদি আরব সফর করেছেন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে প্রায় ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি হয়। হোয়াইট হাউস বলছে, রিয়াদে হওয়া এই চুক্তিকে ওয়াশিংটন ও রিয়াদের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রির চুক্তি। ইসরাইলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে সৌদি আরবকে আহ্বান জানিয়ে আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগ দিতে ট্রাম্প আহ্বান জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে তিনি একে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ এবং তার জন্য ব্যক্তিগত সম্মানের বিষয় হবে বলেও মন্তব্য করেন। সৌদি আরব ৩০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। গত ১৩ তারিখ রিয়াদে সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ ফোরামে তিনি এই ঘোষণা দেন। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেন, আমরা বর্তমানে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছি এবং দ্রুতই এটি ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সৌদি ভিশন ২০৩০-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং দুই দেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তি হচ্ছে এই যৌথ বিনিয়োগ। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দেশের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এবং সেই অংশীদারিত্ব আরও গভীর করতেই তারা বৈঠক করেছেন। তিনি বলেন, যৌথ বিনিয়োগ আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের যৌথ তৎপরতা শুধু অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং এটি সম্প্রসারিত হবে বৈশি^ক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তির জন্য। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ট্রাম্পের এই সফর আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও শক্তি সংক্রান্ত সহযোগিতা জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ডিজিটাল কো-অপারেশন অরগাইনাইজেশনের মহাসচিব দিমাহ আল-ইয়াহ্ইয়া বলেন, ট্রাম্পের রিয়াদ সফর শুধু প্রতীকী ছিল না, এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কারও কারও নিকট ‘মাগা ইন দ্য ডেজার্ট’ হিসেবে বিবেচিত ট্রাম্পের এই সফরকে শুধু দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় মৈত্রীর প্রতিফলন হিসেবেই নয়, দুই দেশের ভবিষ্যতে কীভাবে বিশে^র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নেতৃত্ব দিতে পারবে, তার একটা টার্নিং পয়েন্ট হিসেবেও দেখা হচ্ছে। কারণ, এর আগে তাদের নিকট কূটনীতি, মূলধন ও কোডের সমন্বয় কখনো এত জরুরি বিষয় হিসেবে গণ্য হয়নি। ট্রাম্পের সৌদি আরব সফর শুধু কূটনৈতিক সংকেত নয়, এটি একটি কৌশলগত কর্মসূচির আহ্বানও বটে। একটি দ্বিপক্ষীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত যৗথ তহবিল গঠন করা; যা আফ্রিকা, এশিয়া এবং গ্লোবাল সাউথজুড়ে ডিজিটাল সংযোগ সম্প্রসারণের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, শক্তি, লজিস্টিকস ও প্রতিরক্ষা, ডেটা সুরক্ষায় ডিজিটাল ট্রেড ফ্রেমওয়ার্ক, মুক্তবাজার এবং অবকাঠামোর স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করবে।
মধ্যপ্রাচ্য সফরের অংশ হিসেবে গত ১৪ তারিখ সৌদি আরবের রিয়াদে ট্রাম্প সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এটি গত ২৫ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে প্রথম বৈঠক ছিল। বৈঠকে সৌদি যুবরাজও উপস্থিত ছিলেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান অংশ নিয়েছিলেন। গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ওয়াশিংটন সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা করছে, যাতে করে দেশটি মহান হওয়ার আরেকটি সুযোগ পায়। সিরিয়ার ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া একটি সম্মানের বিষয়। সিররিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদ আল-শাইবানি বলেন, এটি একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। এর কারণ হচ্ছে, ১৪ বছর দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়া এখন স্থিতিশীলতা, আত্মনির্ভরতা ও প্রকৃত পুনর্গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরই মধ্যে সিরিয়ার ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। ট্রাম্প বৈঠকে সিরিয়ার নিকট আরও প্রস্তাব রাখেন, সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে হবে। এরই অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীদের সিরিয়া থেকে বিতাড়িত করতে হবে। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, ট্রাম্প সিরিয়ার নিকট ৫টি প্রস্তাব তুলে ধরেন। এর মধ্যে আব্রাহাম চুক্তির আওতায় ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টিও রয়েছে। উল্লেখ্য, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশ দুটি ইসরাইলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ট্রাম্প এখন আশা করছেন, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশ আব্রাহাম চুক্তির আওতায় ইসরাইলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন করবে। ট্রাম্প বলেন, সৌদি যুবরাজ ও এরদোয়ান সিরিয়ার ওপর থেকে বাণিজ্যিক ও ব্যাংকিং খাতের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে উৎসাহিত করেছেন। জিসিসি সম্মেলনে ট্রাম্প আরও বলেন, আমি ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে চাই। তবে শর্ত হচ্ছে তেহরানকে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন, রক্তাক্ত ছায়া যুদ্ধ এবং স্থায়ী ও যাচাইযোগ্য উপায়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর এরদোয়ান তুরস্কের পার্লামেন্টে প্রদত্ত এক ভাষণে বন্ধু ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানান।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি কয়েকটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। হোয়াইট হাউস প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, এসব চুক্তির আওতায় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের অর্থনৈতিক লেনদেন হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য সফরের অংশ হিসেবে সৌদি আরব সফরের পর ট্রাম্প কাতার যান। এই প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সফরে কাতারকে বেছে নিয়েছেন। দেশ দুটি একাধিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং কাতার এয়ারওয়েজ কর্তৃক শতাধিক বোয়িং বিমান ক্রয়ের একটি চুক্তি। ট্রাম্প একে বোয়িংয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘এটা অসাধারণ। এটাই রেকর্ড।’ ৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের চুক্তির আওতায় কাতার এয়ারওয়েজ বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ও ৭৭৭ এক্স সিরিজের মোট ২১০টি উড়োজাহাজ ক্রয়ের পরিকল্পনা কাতারের রয়েছে। কাতারের আল উদিদ বিমানঘাঁটি এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা ও সমুদ্র নিরাপত্তা সুবিধার উন্নয়নে ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের একটি ইচ্ছাপত্রও স্বাক্ষরিত হয়েছে। কাতার যুক্তরাষ্ট্রে তাদের প্রতিরক্ষা বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে এবং এই চুক্তির মাধ্যমে তারা জেনারেল অ্যাটমিকসের ড্রোন ও রেথিয়নের অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম কিনবে। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় কাতারের আমিরের সঙ্গে ২ ঘণ্টার বৈঠকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিকট থেকে কাতার উন্নত প্রযুক্তির এমকিউ-৯বি ড্রোনও কিনবে বলে জানা যায়। শেখ তামিম বলেন, ট্রাম্পের কাতার সফরের মধ্য দিয়ে দোহা এবং ওয়াশিংটনের সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম আঞ্চলিক বিমানঘাঁটি কাতারে অবস্থিত। কাতার বিশ^ব্যাপী বিভিন্ন সংঘাত নিরসনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ওই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক জটিলতার প্রেক্ষাপটে হোয়াইট হাউস এটিকে ট্রাম্পের চুক্তি করার সক্ষমতা প্রদর্শনের সফর হিসেবে বর্ণনা করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা তার চেয়ে বেশি কিছু। কাতার সফরের সময় ট্রাম্প জানান, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি চুক্তি খুব কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে, যা সামরিক পদক্ষেপ এড়াতে সহযোগিতা করবে। ঘোষণাটির পর বিশ^বাজারে তেলের দাম হ্রাস পায়। হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন হলো একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইসরাইলের আবির্ভাব। তবে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো ঘোষণা আসেনি। ট্রাম্প আবারও দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত গাজা দখল করে একে ‘ফ্রিডম জোন’-এ পরিণত করা। তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে চান বলেও উল্লেখ করেন। কাতার সফর ছিল উপসাগরীয় অঞ্চলে ট্রাম্পের সফরের দ্বিতীয় ধাপ।
মধ্যপ্রাচ্য সফরের পূর্বেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ বিক্রির অনুমোদন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। যুক্তরাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতকে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে। এই যুদ্ধবিমান সংক্রান্ত যন্ত্রাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাতকে তাদের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা চাহিদা পূরণে সক্ষম করে তুলবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গত ১৫ মে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান আবুধাবির কাসর আল ওয়াতানে বৈঠক করেন। আগামী দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বলেন, আমিরাতের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত বিনিয়োগগুলো নতুন অর্থনীতি, জ¦ালানি, উন্নত প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং শিল্পের ক্ষেত্রগুলোকে লক্ষ্য করে করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের মহাকাশবিষয়ক উদ্যোগগুলোতে একটি কৌশলগত অংশীদার; যার মধ্যে রয়েছে মঙ্গল অনুসন্ধান কর্মসূচি, মহাকাশচারী মিশন এবং গ্রহাণু বেল্ট অনুসন্ধান প্রকল্প। আবুধাবিতে যৌথভাবে একটি বিশাল ডেটা সেন্টার নির্মাণে অংশীদার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এর লক্ষ্য হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সবচেয়ে বড় ডাটা সেন্টার স্থাপনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এটি প্রাথমিকভাবে একটি এক গিগাওয়াটের এআই ডাটা সেন্টার দিয়ে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত এটি ১০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হবে। প্রকল্পটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন এআই ও ক্লাউড কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে, তারা গ্লোবাল সাউথ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদা আরও ভালোভাবে মেটাতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সাফল্যকে বিশ^ নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে ট্রাম্প প্রশাসন। তাই এআই বিনিয়োগকে জোরদার করার চেষ্টা করছেন ট্রাম্প।  যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিক বলেন, বিশে^র শীর্ষস্থানীয় মার্কিন প্রযুক্তি কাঠামোকে এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদারের সঙ্গে সম্প্রসারণের মাধ্যমে চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের এআই আধিপত্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আরব আমিরাত সরকারও ঘোষণা করেছে যে, তারা ২০৩১ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিশে^ নেতৃত্বের স্থান অর্জন করতে চায়। আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে জ¦ালানি খাতে ৪৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে বলেছে, এই চুক্তি এআই অবকাঠামো, সেমিকন্ডাক্টর, জ¦ালানি ও উৎপাদন খাতে মার্কিন অর্থনীতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিদ্যমান বিনিয়োগকে যথেষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি করবে। ট্রাম্প বলেছিলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ^জুড়ে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রচেষ্টাকে সমর্থনের ক্ষেত্রে কৌশলগত অংশীদার। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এই অঞ্চল এবং বিশ^জুড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য ওয়াাশিংটনের সঙ্গে যৌথ কাজ চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরও বলেন, আমি নিশ্চিত যে, এই সফর আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভবিষ্যতের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মার্কিন মিশন এক্স পোস্টে বলেছেন, একসঙ্গে, দুই নেতা মার্কিন-সংযুক্ত আরব আমিরাত বন্ধুত্বে একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত করবেন এবং আমাদের কৌশলগত অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করবেন।
ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য সফর প্রসঙ্গে বলেন, এটি একটি রেকর্ড সফর। এমন কোনো সফর এখনো হয়নি যা ৪-৫ দিনের মধ্যে ৩.৫-৪ ট্রিলিয়ন ডলার বাণিজ্য চুক্তি করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, তার এবারের সফরে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নতুন বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে নতুন বিনিয়োগ, বিশেষ করে তাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম সম্পদ তহবিল থেকে তিনি বিনিয়োগ পাওয়ার চেষ্টা করছেন। এটি তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি বাস্তবায়নে সহায়তা করবে বলে তিনি মনে করেন। তবে সম্প্রতি ট্রাম্প যে নতুন করে শুল্কনীতি ঘোষণা করেছেন, তা বৈশি^ক বাণিজ্য, আস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। এই সফরের মাধ্যমে তিনটি আরব ধনী দেশের সঙ্গে তার আলোচনার ফলে সেই বাধা কিছুটা হলেও কাটতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন সফর ইতিহাসে বিরল, যেখানে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের পরিবার নিজ দেশে ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি সফরকৃত দেশগুলোতেও নিজস্ব ব্যবসা সম্প্রসারণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। তবে তার এমন পদক্ষেপ ট্রাম্পের পররাষ্ট্র ও বাণিজ্যনীতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, উপসাগরীয় অঞ্চলটিতে বিশাল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করেন কেবল কয়েকজন নেতা। এ জন্যই বাণিজ্যের পরিসর বৃদ্ধি করতে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যকে বেছে নিয়েছেন। একইসঙ্গে পারিবারিক ব্যবসাকেও লাভজনক করেছেন। ট্রাম্পের এই সফরে কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগ ছিল না। মধ্যপ্রাচ্য সংকট সমাধানেও উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি। তবে কোনো বিশ্লেষক মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের এই সফরকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে মার্কিন প্রভাব পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখছেন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×