ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কাহালুর প্রতিটি ঘর এখন শিল্প কুটির

তালপাতার আঁশের তৈরি হস্তশিল্প যাচ্ছে ইউরোপে

মাহমুদুল আলম নয়ন

প্রকাশিত: ০০:০৮, ২৪ মে ২০২৫

তালপাতার আঁশের তৈরি হস্তশিল্প যাচ্ছে ইউরোপে

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাঁচখুর গ্রামে তালপাতার আঁশ দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত নারী-পুরুষ

প্রাচীন যুগে পাণ্ডলিপি তৈরিতে ব্যবহার হতো তালপাতা। তালপাতার বাঁশির নাম তো সবারই প্রায় জানা। আর তালপাতার অংশ বিশেষের আঁশ দিয়ে তৈরি পণ্য বগুড়ার কাহালুর ১০ গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারের উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বিনি সুতার মালা গাঁথার মতো তালের আঁশের হস্তশিল্প এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে এই গ্রামীণ জনপদের নারীরা। গ্রামের এক একটি ঘর যেন এক একটি শিল্প কুটির। যেখানে নিপুণ হাতে সুঁই বা সুতা ছাড়াই শুধু তালপাতার (কা-ের নিচের অংশ) আঁশ দিয়ে শৈল্পিক নৈপুণ্যে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন শো পিস থেকে নানা ধরনের পণ্য।

নারীদের তৈরি এসব পণ্য এখন বগুড়া থেকে যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। শুধু বিদেশ নয়, দেশের বাজারেও এখানকার তালপাতার আঁশ দিয়ে তৈরি পণ্যের বাজার বিস্তৃত হচ্ছে। এখানকার তালপাতরা আঁশের শিল্পীরা যে কোনো নমুনা দেখেই তৈরি করতে পারেন নান্দনিক ও চিত্তাকর্ষক সব পণ্য। ঝুড়ি থেকে টুপি ও বিভিন্ন ধরনের ম্যাটসহ চোখ জুড়ানো-মনকাড়া সব পণ্য। সংসারে সাজিয়ে রাখার মতো ব্যবহার্য নানা ধরনের ঝুড়িসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। শিল্পীর নৈপুণ্য, দক্ষতা ও বুননে তৈরি এক একটি পণ্য শিল্পকর্মে রূপান্তরিত হচ্ছে। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম কাহালুর পাইকর ইউনিয়নের পাঁচখুর। এই গ্রাম ঘিরেই গড়ে উঠেছে তালপাতার আঁশের তৈরি হস্তশিল্পের পণ্য তৈরির একাধিক পল্লী। গ্রামের প্রতিটি বাড়িই  এখন এক একটি শিল্পকুটির।

এই গ্রাম ঘিরে আশপাশের ভুগইল, চকনদির, ভাদাহার, দামগড়া, পিলগঞ্জ, উতরাই, বনবোনাই, পাঁচগ্রামসহ অন্তত দশটি গ্রামে তালপাতার আঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা শিল্প। সুঁচ সুতা ছাড়া শুধু তালপাতার আঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে হচ্ছে নানা পণ্য। নারীরাই এর প্রধান কারিগর হলেও পুরুষেরা এতে সহায়তা করেন। সাংসারিক কাজের পাশে এসব গ্রামের নারীদের স্বনির্ভরতার পথ দেখিয়েছে এই তাল পাতার আঁশ। পাচখুর গ্রামের ঢুকে তালপাতার আঁশের হস্তশিল্পের কথা জিজ্ঞেস করতেই এগিয়ে এলেন গোলাম রসুল। বললে, নমুনা এনেছেন।

নমুনা দিলেই তালের আঁশের যে কোনো পণ্য তৈরি করে দিতে পারেন তারা। বললেন, এখন ধানকাটা মাড়াই মৌসুমের কারণে তালের আঁশের কাজের চেয়ে গৃহস্থালী কাজে বেশি মনোযোগ সবার। তার পরেও প্রতি বাড়িতেই নারীরা কাজ করছেন। তার স্ত্রী রিমা খাতুনও তালপাতার আঁশের কাজ করেন। এখন ঘরে ধান ওঠানোর কাজের চাপে তালের আঁশের পণ্য তৈরির কাজ তেমন করছেন না। তবে প্রতি বাড়িতেই নারীরা এর মাঝেই কাজ করছেন।
লাভলি আকতার ও শান্তনাসহ কয়েক নারী এক সঙ্গে বাড়ির দরজা থেকে সামনের অংশে তালের আঁশ দিয়ে ঝুড়ি, টুপি ও বিভিন্ন ধরনের শো পিস তৈরি করছিলেন। প্রতিদিন তারা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিরতি দিয়ে কাজ করেন। লাভলি জানালেন, একই উপজেলা পিড়াপাঠ এলাকায় তার পিতার বাড়ি। স্বামীর বাড়ি পাঁচখুর। এখানে এসেই তালের আঁশ দিয়ে নানা পণ্য তৈরি করা শিখেছেন, অন্য নারীদের সঙ্গে থেকে। এ থেকে উপার্জিত অর্থ সংসারে কাজে লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছে শক্তি মনে হয়।

কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য স্বামীর কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। সচ্ছল শান্তনার স্বামী থাকেন বিদেশে। দুই মেয়ের একটিকে বিয়ে দিয়েছেন। প্রায় ১৫ বছর ধরে তালের আঁশ দিয়ে নানা পণ্য তৈরির কাজ করছেন। জানালেন, এসব পণ্য বাইরে গিয়ে বিক্রি করতে হয় না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট ও পাইকাররা তাদের কাছ থেকে কিনে নেন। এক একটি পণ্য প্রকার ভেদে ২০-১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন। দিনে ২-৩শ’ টাকার পণ্য তৈরি করতে পারেন। তারা জানালেন, তালপাতার নিচের অংশ স্থানীয় ভাষায় ঢেঙ্গু প্রথমে হাতুড়ি দিয়ে থেতলানো হয়। পরে তার আঁশ বাঁশের তৈরি কাঠি দিয়ে ছাড়িয়ে সুতার মতো তৈরি করার পর পরিষ্কার করে শুকানো হয়। এর পরেই সুতার মতো এক ধরনের আঁশ পাওয়া যায় আর এটি দিয়েই তারা তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের পণ্য।

নাছির উদ্দিন ও তার বোন খাদিজার পরিবার তালের আঁশের পণ্য তৈরির সঙ্গে বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি থেকে পণ্য কিনে এনে পাইকারদের সরবরাহ করেন। নাছির উদ্দিন জানালেন ঢাকা, রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় এসব তালের আঁশ দিয়ে তৈরি পণ্য সরবরাহ করণে। প্রতি মাসে দেড় থেকে ৩ লাখ টাকার পণ্য কিনে তিনি পাঠান। আর খাদিজার স্বামী নইমুদ্দিন রিক্সা ভ্যানে আশপাশের জেলা থেকে কা-সহ তালপাতা (স্থানীয় ভাষা ঢেঙ্গু) কিনে আনেন। তালপাতার আঁশ তৈরির জন্য তা  বাড়ি বাড়ি বিক্রি করেন। তালপাতার পণ্য তৈরির গ্রামগুলোতে প্রায় ৩০-৪০ জন বিভিন্ন এলাকা থেকে কা-সহ তালপাতা কিনে এর গোড়ার অংশ বা ঢেঙ্গু বিক্রি করে ২৫-৫০ টাকা দরে বলে জানান খাদিজা।

পাঁচখুর পূর্বপাড়ার ইউনুছ আলী একসময় বাড়িতেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তালপাতার আঁশ দিয়ে হস্ত শিল্পের পণ্য তৈরি করতেন। এখন তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট হিসেবে নিজের গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে অর্ডার অনুযায়ী পণ্য সংগ্রহ করে তার সঙ্গে চুক্তিকৃত প্রতিষ্ঠানে পণ্য পাঠান। তিনি জানান, তিনি যে সব প্রতিষ্ঠানের হয়ে পণ্য ক্রয় করে পাঠান সেগুলো জার্মানি, ইতালি ও ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এখাকার নারীদের তৈরি পণ্য যায়। তিনি জানান, শুধু নারীরা নয়, পুরুষরাও এসব পণ্য তৈরিতে সহায়তা করেন। কাহালুর পাইকর ও কালাই ইউনিয়নের প্রায় ১০টি গ্রামের প্রায় ৩ হাজার কর্মী তাদের কাছে ৪০-৫০ ধরনের পণ্য সরবরাহ করেন। প্রতিমাসে তিনি ২-৭ লাখ টাকার মতো পণ্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠান।

বিদেশ ও দেশের বিভিন্নস্থানে পন্য পাঠানোর আরও কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি পাঁচখুর পশ্চিমপাড়ার ইউসুফ আলী জানান, আগে তিনি তৈরি করতেন। ৮ বছর ধরে বিভিন্ন গ্রামের কারিগরদের দিয়ে পণ্য তৈরি করে পাঠান। পাঁচখুর, ভুগইল বনমোনাই গ্রামের প্রায় ১ হাজার কারিগর তার কাছে পণ্য বিক্রি করে। এসব পণ্যের প্রতিটি ১৫ থেকে ৭-৮ শ’ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠান নমুনা সরবরাহ করার পর তিনি তালের আঁশ তৈরির কারিগরদের দিয়ে তা তৈরি করে নেন।

তিনি জানান, এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ার কারণে গ্রামে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। গ্রামের নারীদের অন্য গ্রামে বিয়ে হওয়ার পর তাদের মাধ্যমে আবার পাশের গ্রামের এসব পণ্য তৈরির নতুন শিল্পঘর হয়ে উঠছে। এভাবেই কাহালুর পাঁচখুর গ্রামের তালের আঁশ দিয়ে তৈরি পণ্যের নারী কারিগরদের সংস্থান বাড়ছে আর পণ্য তৈরির নতুন পয়েন্টও গড়ে উঠছে আশপাশের গ্রামজুড়ে।

×