ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সোশ্যাল মিডিয়া কি আমাদের আত্মপরিচয় কেড়ে নিচ্ছে?

শেখ ফরিদ

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২৪ মে ২০২৫

সোশ্যাল মিডিয়া কি আমাদের আত্মপরিচয় কেড়ে নিচ্ছে?

ছবি: সংগৃহীত

বাংলা সাহিত্যের অগ্রদূত মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনকাহিনী যেন আমাদের এক চিরন্তন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়—আমি কে?

একজন অসাধারণ ভাষাবিদ ও কল্পনাশক্তির অধিকারী হয়েও জীবনের একটি দীর্ঘ সময় তিনি নিজেকেই চিনতে পারেননি। জন্মেছিলেন এক বাঙালি পরিবারে, কিন্তু এক সময় মনে হয়েছিল—এই পরিচয়, এই ধর্ম, এই সংস্কৃতি সবই ভুল। ত্যাগ করেছিলেন হিন্দু ধর্ম, গ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টধর্ম। শুরু করেছিলেন ইংরেজিতে কবিতা লেখা, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন পাশ্চাত্যই শ্রেষ্ঠ। বাংলাকে বলেছিলেন—"পয়েট্রির অযোগ্য।"

কিন্তু সময় বদলায়। বিদেশী জীবনের মোহ কেটে গেলে যখন তিনি নিজের শেকড়ে ফিরে তাকান, তখনই জেগে ওঠে আসল পরিচয়ের অনুভব। মনে পড়ে যায় কপোতাক্ষ নদ, বাংলা ভাষা, মায়ের মুখ। তখনই সৃষ্টি হয় সেই অমর পঙ্‌ক্তি—
"সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে।"

মধুসূদনের এই যাত্রা শুধুই একজন কবির গল্প নয়, এটা সেই যাত্রার কথা যেখানে মানুষ নিজের পরিচয় খুঁজতে গিয়ে সবকিছু হারিয়ে আবার ফিরে আসে নিজের কাছে।

আজকের সমাজে এই প্রশ্ন আরও তীব্র—"আমি কে?"
আমার নাম, ধর্ম, ভাষা—এগুলো কি যথেষ্ট? নাকি এই আমি এখনো খুঁজে ফিরছি নিজেকে?

পরিচয় সংকট: মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা
মনোবিজ্ঞানী এরিক এরিকসনের মতে, জীবনের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় মানুষ, যেখানে সে নিজের ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু সামাজিক প্রত্যাশা, পারিবারিক মূল্যবোধ, ক্যারিয়ার চাপ—সব মিলিয়ে সেই নিজেকে খুঁজে পাওয়াটা হয়ে ওঠে যুদ্ধ। কেউ সফল হয়, কেউ হয়তো সারা জীবন নিজের মুখে মুখোশ এঁকে কাটিয়ে দেয়।

আজ এই সংকট শুধু দর্শন বা সাহিত্যে সীমাবদ্ধ নয়। সোশ্যাল মিডিয়া এখন এই ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-এর আধুনিক কারখানা। এখানে সবাই সুখী, সফল, পারফেক্ট—কারও ১৮ বছর বয়সে গাড়ি, কারও মাসে লাখ টাকা আয়, কেউ বলছে—"নিজের উপর বিশ্বাস রাখো"—আর আপনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছেন, “আমি তাহলে কি ব্যর্থ?”

কিন্তু আপনি জানেন না, সেই সাফল্য হতে পারে লোনে কেনা, সেই হাসি হতে পারে বুক ভাঙা কষ্টে ঢাকা। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই দেখায় কে কতটা ভালো, কিন্তু কেউ বলে না কে কেমন আছে।

শুরু হয় আত্মসন্দেহ, জন্ম নেয় অপরাধবোধ
নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে করতে তৈরি হয় এক কৃত্রিম আমি। রিয়েল বানাতে গিয়ে আমরা হারিয়ে ফেলি নিজের রিয়েল ফিলিংস। সুখী দেখাতে গিয়ে ভুলে যাই দুঃখের গভীরতা। এবং তখনই প্রশ্ন আসে—"আমি কি সত্যিই আমি?"

এই সংকটের ভয়াবহতা
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, দীর্ঘস্থায়ী পরিচয় সংকট থেকে জন্ম নিতে পারে হতাশা, আত্মসম্মানবোধের অভাব, এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও।

কারণ, যখন কেউ নিজের অস্তিত্বকে বোঝে না, তখন তার কাছে পৃথিবীর কোনো কিছুই অর্থবহ মনে হয় না।

তবে এখানেই শেষ নয়, প্রত্যেকটা আত্মার গভীরে থাকে একটি আলো, যেটা জ্বলতে পারে যদি আপনি নিজেকে জানার সুযোগ দেন।

প্রথম ধাপ: নিজের সঙ্গে সত্যবাদী হন
– আপনি কী ভালোবাসেন?
– কাদের সঙ্গে স্বস্তি বোধ করেন?
– কিসে আনন্দ পান, কিসে চাপ অনুভব করেন?

এই প্রশ্নগুলো ছোট মনে হলেও এখানেই লুকিয়ে আছে আপনার সত্যিকারের পরিচয়। অন্যের মাপকাঠিতে নিজেকে না মেপে নিজের মতো বাঁচুন।

নিজের আগ্রহকে গুরুত্ব দিন—গান, লেখা, রান্না, ছবি আঁকা—যেটাতেই ভালো লাগুক, তাকে গুরুত্ব দিন। কিছুদিন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরতি নিন। নিজের সাথে একা সময় কাটান। তবেই বুঝতে পারবেন—আপনি আসলে কে, কী চান, কী আপনাকে শান্তি দেয়।

সাহায্য নিন, বন্ধু বা পরিবারের। নিজের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন।

নিজের পরিচয় খুঁজে পাওয়া সহজ নয়, তবে এই খোঁজটাই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সফর।

 

 এসএফ

×