
কুরবানির ঈদ মুসলমানদের জন্য একটি গভীর ধর্মীয় উপলক্ষ। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যে যার সাধ্য অনুযায়ী পশু কুরবানি করে থাকেন। আর এই কুরবানিকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে দেশের সবচেয়ে বড় মৌসুমি বাজার কুরবানির হাট। তবে এই ঈদ বাজার নিয়ে মানুষের মাঝে যেমন আনন্দ ও উৎসাহ থাকে, তেমনি রয়েছে অসংখ্য ভোগান্তি, প্রতারণা এবং অনিয়মের বাস্তবতা। এর পেছনে রয়েছে সম্ভাবনার বিশাল ক্ষেত্রও, যেটিকে সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো এখন সময়ের দাবি।
পশুর হাটগুলোর অবস্থান, অবকাঠামো এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে বহুদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে। শহর কিংবা গ্রামীণ অঞ্চলে অধিকাংশ হাটই খোলা জায়গায় বসে। যেখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই, নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, আলো বা স্বাস্থ্যবিধির প্রস্তুতি। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই গাদাগাদি ভিড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হয়। বিশেষ করে বৃষ্টির দিনে কাদা-পানিতে একাকার হয়ে যায়।
গরু বা ছাগল নিয়ে হাটে যাওয়ার সময় বিশেষ করে দূর-দূরান্ত থেকে ঢাকামুখী যাত্রায়, পথে পথে চাঁদাবাজির শিকার হন খামারিরা। ট্রাক বা পিকআপে করে পশু নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে গেলে বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে চাঁদা আদায় হয়। কোনো কোনো জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যও এ সুযোগে অনৈতিক সুবিধা নেন। এভাবে পশু পরিবহনে প্রতিটি গাড়িতে হাজার হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়, যা শেষ পর্যন্ত পশুর দামে প্রভাব ফেলে এবং ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়।
পশুর দামের ব্যাপক তারতম্য ও দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য ক্রেতাদের জন্য বড় যন্ত্রণা। একই গরু এক হাটে বিক্রি হচ্ছে ৮০ হাজার টাকায়, অন্য হাটে তার দাম লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দালালরা হাটে ঢোকার আগেই গরুর মালিককে কম দামে কিনে নেয় এবং অনেক বেশি দামে বিক্রি করে দেয়। এতে প্রকৃত খামারি ন্যায্য দাম পান না এবং সাধারণ ক্রেতা ঠকে যান।
একইসঙ্গে জাল নোট একটি ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে প্রতিবারই উঠে আসে। হাটে প্রচুর নগদ লেনদেন হয়, আর সেই সুযোগে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল নোট চক্র। অনেক সময় গরু বিক্রেতারা লাখ টাকার লেনদেনে কয়টি জাল নোট বুঝতে পারেন না। পরে ব্যাংকে গিয়ে বুঝতে পারেন তারা প্রতারিত হয়েছেন। এই চক্র দমন করতে হাটগুলোতে পর্যাপ্ত ব্যাংক বুথ, জালনোট শনাক্তকারী মেশিন এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম খুবই জরুরি।
অন্যদিকে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা পশু এখন একটি বড় প্রতারণা। হরমোন বা স্টেরয়েড প্রয়োগ করে গরুকে অস্বাভাবিক মোটা দেখানো হয়। অথচ এর স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থাকে মারাত্মক। এমন গরুর মাংস স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ এবং কুরবানির উদ্দেশ্যও পূর্ণ হয় না। অথচ পশু চিকিৎসা কর্তৃপক্ষ ও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় এই ধরনের অসুস্থ গরু নির্বিঘ্নে হাটে উঠছে।
এছাড়া অনলাইন কোরবানির হাটও প্রতারণার নতুন রূপ নিয়েছে। ছবি দেখে আকর্ষণীয় পশু কেনার পর বাস্তবে পাওয়া যাচ্ছে রোগাক্রান্ত বা ছোট আকারের পশু। আবার অনেকেই অর্থ পরিশোধ করার পর পশু পাচ্ছেন না। এই খাতকে নিরাপদ করতে হলে সরকার অনুমোদিত ওয়েবসাইট ও বিক্রেতাদের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে হবে।
তবে এসব সমস্যার মাঝেও কোরবানির ঈদ বাজার একটি বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র। গো-খাত, পশুপালন, পশু পরিবহন, খাদ্য, ওষুধ, চামড়া শিল্পসহ অনেকগুলো খাত এই সময়টি ঘিরে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎস সৃষ্টি করে। লাখ লাখ খামারি ও শ্রমজীবী মানুষ ঈদের মৌসুমি আয়েই সারা বছরের খরচ চালান। সরকারি সহায়তায় হাট ব্যবস্থাপনাকে উন্নত, প্রযুক্তিনির্ভর এবং স্বচ্ছ করে গড়ে তোলা গেলে এ খাত জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারে।
চামড়া শিল্প নিয়েও রয়েছে অনেক সম্ভাবনা। যদিও ঈদের সময় সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও সংগ্রহ না হওয়ায় প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার চামড়া নষ্ট হয়। এই চামড়া রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ থাকলেও অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না।
সবশেষে বলা যায়, কুরবানির ঈদ কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক বৃহৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও। এ সময়ের প্রতিটি সংকট ও প্রতারণা বন্ধে কঠোর নজরদারি, জনসচেতনতা এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। কোরবানির ঈদ বাজার যেন হয় নিরাপদ, স্বচ্ছ এবং সবার জন্য কল্যাণকর এই হোক আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস।
শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর
প্যানেল