
চলচ্চিত্র বিনোদন জগতের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম, যা একই সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও চলচ্চিত্র শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। চলচ্চিত্র একটি প্রারম্ভিক সোর্স বিনোদন ও সাংস্কৃতিক জগতের বলে গণ্য করা হয়। চলচ্চিত্র দেখা এবং চলচ্চিত্রকে উপভোগ করার মাঝেও এক আত্মিক শান্তি রয়েছে। চলচ্চিত্র যাচাই-বাছাই করাও ব্যাক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ সিনেমাও এক ধরনের আর্ট। এমন আর্ট যা সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। এ সব ফেক্টর একসাথে যখন কাজ করে তখন এটিকে ফরাসি ভাষায় ‘রাপোর্ট দে প্রোডাকশ’ বলা হয়। এই শিল্প স্বর্ণযুগ পার করলেও নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে এর জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আবারও নবজাগরণের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সূচনা ও স্বর্ণযুগ
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের যাত্রা শুরু মূলত পাকিস্তান আমলে। ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) নামে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই সময় মুক্তি পাওয়া ‘মুখ ও মুখোশ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘ওরা এগারো জন’, ‘স্টপ জেনোসাইড’ চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ (১৯৭০) ছিল সে সময়কার এক অনন্য রাজনৈতিক চলচ্চিত্র, যা পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম হয়েছিল।
৭০-এর দশকের পরেও খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’, আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ এবং সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ সিনেমাগুলো সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরে দর্শকদের মুগ্ধ করে।
স্বর্ণযুগের পতন ও বাণিজ্যিকীকরণের যুগ
১৯৮০-৯০ দশকের দিকে বাংলা সিনেমার জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে। সিনেমার মানোন্নয়নে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও মৌলিক গল্পের চাহিদার দিকে মনোযোগ না দিয়ে কেবল বাণিজ্যিক লাভের কথা ভাবা হয়।
এর ফলে নিম্নমানের সিনেমার সংখ্যা বাড়তে থাকে, যা দর্শকদের সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করে। তখনকার অনেক সিনেমায় অশ্লীলতা, কৃত্রিম অ্যাকশন ও নিম্নমানের গল্পের প্রভাব দেখা যায়। তবে এই সময়ও সালমান শাহ, শাবনূর, রিয়াজ, মান্নার মতো জনপ্রিয় তারকারা চলচ্চিত্রে এক ধরনের গ্ল্যামার ফিরিয়ে আনেন।
২০০০ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশী সিনেমায় বিদেশী প্লট নকল, দুর্বল সম্পাদনা এবং নিম্নমানের স্ক্রিপ্টের আধিক্য দেখা যায়। দর্শকদের আস্থা হারিয়ে সিনেমা হলগুলো একের পর এক বন্ধ হতে থাকে। তবে একই সময়ে ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘মনপুরা’-এর মতো সিনেমাগুলো সিনেমার প্রতি দর্শকদের নতুন করে আগ্রহী করে তোলে।
ওটিটি যুগ ও নতুন ধারার সিনেমা
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা চলচ্চিত্র আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বিশেষত ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উত্থানের ফলে ভিন্নধর্মী গল্প ও মানসম্মত নির্মাণের দিকে মনোযোগ বেড়েছে।
নুহাশ হুমায়ূনের ‘মশারী’ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তার ‘পেট কাটা ষ’ সিরিজটিও দর্শকদের নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা দিয়েছে। মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ সিনেমাটি ব্যতিক্রমী গল্প ও সিনেমাটোগ্রাফির জন্য জনপ্রিয়তা পায়।
বড় বাজেটের সিনেমাগুলোও ভালো করছে। যেমন, ‘আয়নাবাজি’, ‘পোড়ামন ২’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘প্রিয়তমা’, ‘তুফান’ ইত্যাদি সিনেমা দর্শকদের হলমুখী করেছে। উন্নতমানের সিনেমাটোগ্রাফি, বাস্তবধর্মী গল্প এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এসব সিনেমাকে দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে।
চলচ্চিত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বর্তমানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প নতুন সম্ভাবনার দিকে এগোচ্ছে, তবে গুণগত মান নিশ্চিত করা এখনো চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে বাংলা সিনেমার সামনে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
সেন্সর বোর্ডের অস্পষ্ট নীতিমালা অনেক সময় নতুন ও ভিন্নধর্মী কনটেন্ট সেন্সরশিপের মুখে পড়ে।
সিনেমা হল সংকট- পুরনো সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যা নতুন সিনেমার বাজারকে সংকুচিত করছে।
৩. টেকনোলজির উন্নয়ন দরকার আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা নির্মাণের জন্য উন্নত ভিএফএক্স, ক্যামেরা ও পোস্ট-প্রোডাকশন সুবিধা প্রয়োজন।
৪. মৌলিক গল্পের অভাব- অনেক নির্মাতা এখনো পুরনো ধাঁচের গল্পে আটকে আছেন, যা দর্শকদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়।
ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উত্থান- স্বল্প বাজেটে মানসম্মত কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছে।
নতুন নির্মাতাদের আগমন- রায়হান রাফি, নুহাশ হুমায়ূন, মেজবাউর রহমান সুমনের মতো তরুণ নির্মাতারা নতুন ধারা তৈরি করছেন।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি- বাংলাদেশী চলচ্চিত্র বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নিচ্ছে এবং পুরস্কারও জিতছে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প বর্তমানে পুনর্জাগরণের পথে রয়েছে। মানসম্পন্ন গল্প, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং সঠিক বিনিয়োগ থাকলে বাংলা সিনেমা আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে। সৃজনশীল কাজ ও কন্টেন্টের গুণগতমান নিশ্চিত করা গেলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের সিনেমার অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]