ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩০ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হারিয়ে যাওয়া সেই ডাক: “ফিতা লাগবে গো?”

তানিম মল্লিক, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১০:৩৪, ২৯ মে ২০২৫

হারিয়ে যাওয়া সেই ডাক: “ফিতা লাগবে গো?”

ছবি: সংগৃহীত

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যার টানে হালকা হাওয়া আসে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে পড়ে যায় এক সুর... “ফিতা লাগবে গো?”—একটা কণ্ঠস্বর নয়, একসময়ের চেনা ছন্দ। যেন বাতাসে মিশে যাওয়া গান, যা শুধুই শোনা যায় মনের ভেতর।
গ্রামের পথ ধরে এক সময় হেঁটে বেড়াতেন কিছু মানুষ। গ্রামীণ মেয়েরা অপেক্ষা করত, কখন সেই মানুষটা আসবেন। হাতে কাঠের বাক্স, সামনে তার কাচ, কাঁধে কাপড়ের ঝোলা—তাতে রঙিন লেইস, বিভিন্ন রঙের কাঁচের চুড়ি, রেশমি ফিতা, টিকলি, ছোট আয়না, পাউডারের খোপ, কিংবা চকচকে সাদা প্যাকেটে গেঁথে রাখা কিছু স্বপ্ন।

কে ছিল সে মানুষ? নাম জানা নেই অনেকেরই। তবু সে ছিল ঘরের আত্মীয়ের মতো। দরজায় এসে বলত, “আপা, নতুন মাল এনেছি। একবার দেখেন না?” কেউ টাকাপয়সা দিতে না পারলে বলত, “নেন তো আপা, কাল দিলেই চলবে।”

কোনো রসিদ ছিল না, ছিল বিশ্বাসের অদৃশ্য সুতোর টান। এই মানুষগুলোর ছিল না কোনো দোকান, তবু তারা নিয়ে আসত এক চলমান হাট। আর সেই হাট ছিল একেকটা মেয়ে বা মায়ের মুখে হঠাৎ হাসি ফোটানোর জাদু।

রূপসার জোয়ার গ্রামের ৭২ বছরের আয়েশা খাতুন এখনো যেন কানে শুনতে পান সেই ডাক। তিনি বলেন, “মেয়ে, এখনকার মেয়েরা বুঝবে না... ওই ডাকটা শুধু কেনাবেচা ছিল না, ও ছিল স্বপ্নের মতো। আমি তখন নতুন বউ। গরমের দুপুরে কাঁঠাল গাছের নিচে বসে থাকতাম, বাতাস থেমে যেত, রোদ ঝিমিয়ে পড়ত, হঠাৎ দূরে ভেসে আসত সেই সুর—‘ফিতা লাগবে গো?’ আমি ছুটে যেতাম দৌড়ে। কাঁধে কাপড়ের ঝোলা, হাতে কাঁচের বাক্স—তার মধ্যে যেন পুরোটাই ছিল একটা মেলার মতো। সবুজ রেশমি ফিতা, কাঁচের চুড়ি, চকচকে আয়না, ছোট ছোট টিকলি, আর ছিল অনেক অনেক অজানা হাতছানির মতো রঙ।”

কিন্তু আজ?

আজ বাজার চলে এসেছে ফোনের পর্দায়। টিকলির দাম জানার জন্য দরজা খুলতে হয় না। আর সেই ডাক—“ফিতা লাগবে গো?”—তা কেবল স্মৃতির গায়ে হাত রেখে বলে, “আমি আর আসব না।”

আজ আর কেউ সেই পথ ধরে হেঁটে আসে না। কেউ এসে দাঁড়ায় না দরজায়, হাতে ছোট আয়নার বাক্স নিয়ে। ছেলেবেলার মতো মেয়ে হয়ে ওঠা এখন অনলাইন অর্ডারে আসে, সেই হাঁটা মানুষের কণ্ঠে নয়।

একটি কণ্ঠ হারিয়ে গেছে মানে শুধু এক ডাক নয়—হারিয়ে গেছে এক সম্পর্ক, যেখানে বেচাকেনার পেছনে লুকিয়ে ছিল নির্ভরতা, মায়া, এক ধরনের আন্তরিকতা।

এই সমাজ বদলেছে, আর সেই বদলের সঙ্গে চুপিচুপি হারিয়ে গেছে এক পেশা, আর তার সঙ্গেই মুছে গেছে কিছু শব্দ, কিছু চেনা মুখ, কিছু ছোট্ট মুহূর্ত।

যে ফিতাগুলো এক সময় কারো চুলের বিনুনি সাজাত, আজ তারা হয়তো বাক্সবন্দি পুরনো কাগজের নিচে ঘুমিয়ে আছে, অথবা কেবল কারো দাদির গল্পে টিকে আছে—‘একজন ফিতা বিক্রেতার কথা।

তবে সেই ডাকে একবারও কি তোমার কান কেঁপে ওঠে না?—“ফিতা লাগবে গো?”
এই চারটি শব্দেই ছিল এক সময়কার সাজঘরের চাবি, আর এখন তা শুধুই এক হারিয়ে যাওয়া সুর।

মুমু

×