ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

যেখান থেকে বার্তা পৌঁছাত দূর দেশে, এখন সেখানে কেবল দখলদারি ও বিস্মৃতি

বাঁধন মোল্ল্যা, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, জামালপুর

প্রকাশিত: ০০:২৯, ৩০ মে ২০২৫; আপডেট: ০০:৩২, ৩০ মে ২০২৫

যেখান থেকে বার্তা পৌঁছাত দূর দেশে, এখন সেখানে কেবল দখলদারি ও বিস্মৃতি

একটি জনাকীর্ণ পরিত্যক্ত ভবন। দেয়ালে ফাটল আর খোলা ছাদ, আর আশেপাশে ঝোপঝাড়ের দখল। কিন্তু এই নীরব ভবনটিই একসময় ছিল মানুষের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু সারমারা ওয়ারলেস স্টেশন।

জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার সারমারা বাজার, বগারচর ইউনিয়ন পরিষদের সামনেই ছিল এই ওয়ারলেস স্টেশন, যা তখনকার দিনে ছিল এক বিস্ময়কর প্রযুক্তির নাম। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট কিংবা আধুনিক টেলিকম সেবার ছিটেফোঁটাও ছিল না তখন। দেশের ভেতর ও দেশের বাইরে বার্তা পাঠানোর একমাত্র ভরসা ছিল এই স্টেশন। সরকারি কাজকর্ম, প্রাথমিক জরুরি বার্তা এবং কখনো কখনো ব্যক্তি পর্যায়ের যোগাযোগও হতো এখান থেকে।

সারমারার হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই নীরব ভবন এক সময় ছিল তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থার অবিশ্বাস্য এক চমক। ১৯৬৫ সালে স্থাপিত সারমারা ওয়ারলেস স্টেশন ছিল এমন একটি প্রযুক্তিগত কেন্দ্র, যা দেশের মানুষকে বিশ্বে কথা বলার সুযোগ করে দিত। সেই সময় যখন টেলিফোনও ছিল দূরের স্বপ্ন, তখন এই ওয়ারলেস স্টেশন হয়ে উঠেছিল মানুষে মানুষে সংযোগের প্রাণকেন্দ্র।

এক সময়ের ব্যস্ততম এই স্টেশন আজ দাঁড়িয়ে আছে পরিত্যক্ত ভবন হিসেবে, ঐতিহ্যের গায়ে জমেছে ধুলোর স্তর, আর ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে অবহেলার আঁধারে।

এই ভবনের আর ছাদ নেই। তবে ছিল আগেকার সময়ের শক্ত টিনের ছাউনি, চারপাশে ইটের দেয়াল। ধীরে ধীরে সেই টিনগুলো একে একে নিয়ে গেছে স্থানীয় কিছু মানুষ। কেউ চুরি করে, কেউ প্রয়োজনে ফলে এখন শুধু ইটের কাঠামোটা কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। প্রযুক্তির এক ঐতিহাসিক আশ্চর্য, আজ যেন শুধুই ভাঙা দেয়াল আর স্মৃতির কাঠামো।

যেখানে মানুষ একসময় আশায় বুক বাঁধতো, এখন সেখানে কেবল নীরবতা। এই স্টেশনের পাশেই ছিল এক বিশাল উঁচু টাওয়ার, যার একাংশ দূর ভারতের সীমান্ত থেকেও দেখা যেত। স্থানীয় প্রবীণরা জানায়, তখন ভারতের মানুষ এই টাওয়ার দেখে বিভ্রান্ত হতো, ভাবতো এটি কোনো সামরিক স্থাপনা। লোককথা অনুযায়ী, একপর্যায়ে ভারতীয় হেলিকপ্টারে করে টাওয়ারটির অর্ধেকের বেশি অংশ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই থেকেই টাওয়ারটি আর কখনও আগের মতো জাগ্রত হয়ে ওঠেনি।

মানুষের দখলে হারিয়ে যাওয়া রাজস্ব সম্পদ—বর্তমানে কেবল ভবনটিই নয়, আশপাশের জায়গাগুলিও স্থানীয় কিছু বাসিন্দার দখলে। সরকারি জায়গা এখন ব্যক্তি মালিকানার মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রশাসনিক তদারকির অভাবে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।

সংরক্ষণ নয়, চলছে বিস্মৃতি। যেখানে থাকা উচিত ছিল সংরক্ষণের উদ্যোগ, সেখানে রয়েছে নিঃস্তব্ধতা। নেই কোনো ফলক, নেই কোনো ইতিহাসচিত্র, নেই নতুন প্রজন্মকে জানানোর কোনো ব্যবস্থা। অথচ এ ছিল সারমারার জন্য এক প্রযুক্তিগত অগ্রগতির অনন্য নিদর্শন।

আবার কি জেগে উঠবে গর্ব?
স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি, এই স্থাপনাটি শুধু সংরক্ষণ নয়, বরং গবেষণা ও ইতিহাসচর্চার উপযুক্ত একটি স্থান হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি। নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা উচিত এই কেন্দ্রীয় সংযোগ স্থাপনার প্রকৃত ইতিহাস, যা শুধু সারমারার গর্ব নয়, গোটা বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

ধুলো পড়েছে ঐতিহ্যের গায়ে, কিন্তু সেই ধুলোর নিচেই লুকিয়ে আছে এক বিস্ময়কর গল্প। এখন সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার, ইতিহাস খুঁড়ে জেগে উঠবে কি সারমারার সেই গর্ব, নাকি আরও একটি অধ্যায় মিলিয়ে যাবে বিস্মৃতির কুয়াশায়?

মুমু

×