
এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমের বাজার ‘কানসাট’
গাছে ঝুলছে কাঁচাপাকা আম। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে ফজলি, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি, আশ্বিনা, বোম্বাইসহ অগণিত দেশি-বিদেশি জাতের আম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে এ রকম একটি ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শুধু আমই নয়। বিলুপ্তপ্রায় কাঁসা-পিতল, নকশীকাঁথা ও রেশমের মতো ঐতিহ্যবাহী সামগ্রীতেও সমৃদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জ। একই সঙ্গে আলকাপ ও গম্ভীরার মতো লোকজ উপাদানে সমৃদ্ধ এ জেলা। আবহমান বাংলার অনেক প্রাচুর্যের স্মৃতি বুকে ধারণ করে আছে স্থানটি।
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এ জেলার পূর্বে রাজশাহী ও নওগাঁ, উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিম ও দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও পদ্মা নদী। অতীতে এ এলাকা ‘নবাবগঞ্জ’ নামে পরিচিত ছিল। প্রাক-ব্রিটিশ আমলে এলাকাটি ছিল মুর্শিদাবাদের নবাবদের প্রমোদ ভ্রমণের কেন্দ্র। যার অবস্থান ছিল বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার দাউদপুর মৌজায়। নবাবরা তাদের পাত্র-মিত্র ও পারিষদসহ এখানে শিকারে আসতেন। জনশ্রুতি আছে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সরফরাজ খাঁ একবার শিকারে এসেছিলেন। তিনি যেখানে ছাউনি ফেলেছিলেন সে জায়গাটিই পরে ‘নবাবগঞ্জ’ নামে পরিচিতি পায়। তবে গবেষকদের মতে, নবাব আলীবর্দী খাঁর আমলে ‘নবাবগঞ্জ’ নামকরণ হয়। অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়ে বর্গীদের ভয়ে অনেক মানুষ পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে ওই এলাকায় বসতি গড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে এখানে কর্মব্যস্ত জনপদ গড়ে ওঠে। ফলে চারদিকে নবাবগঞ্জের নাম ছড়িয়ে পড়ে। নবাবগঞ্জের ডাকঘরটির অবস্থান ছিল ‘চাঁপাই’ নামের একটি গ্রামে। এর সূত্র ধরেই ‘নবাবগঞ্জ’ ধীরে ধীরে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ হয়ে ওঠে।
‘চাঁপাই’ গ্রামটির নামকরণ নিয়ে দু’রকম মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। গবেষকদের এক পক্ষের দাবি, বর্তমান নবাবগঞ্জ শহর থেকে পাঁচ বা ছয় মাইল দূরে মহেশপুর গ্রামে নবাব আমলে ‘চম্পাবতী’ মতান্তরে ‘চম্পারাণী’ কিংবা ‘চম্পা বাঈ’ নামে এক সুন্দরী বাঈজি বাস করতেন। তিনি নবাবদের প্রিয়পাত্রী হয়ে ওঠেন। তার নামানুসারে ‘চাঁপাই’ নামকরণ করা হয়। আর একদল গবেষকের মতে, এ অঞ্চলে রাজা লখিন্দরের বাসভূমি ছিল। লখিন্দরের রাজধানীর নাম ছিল ‘চম্পক’। যদিও ‘চম্পক নগরী’র প্রকৃত অবস্থান নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তারপরও চম্পক নগরীতে ‘চসাই’, ‘চান্দপুর’, ‘বেহুলা গ্রাম’ ও ‘বেহুলা নদী’র সন্ধান পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের মতে, বেহুলা তার স্বামীকে ভেলায় নিয়ে মহানন্দার উজান বেয়ে ভেসে গিয়েছিলেন। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ‘চম্পকনগর’ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। কালক্রমে চম্পক থেকে ‘চাঁপাই’ নামের উৎপত্তি হয়।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশসহ এ অঞ্চল রাজশাহী বিভাগের আওতায় আনা হয়। ১৯০৬ সালে নবাবগঞ্জে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস স্থাপন করা হলে কর্মতৎপরতা আরও বাড়ে। পরে সরকারি কাজ-কর্মের সুবিধার্থে ‘চাঁপাই’ গ্রামে অবস্থিত ডাকঘরটি ১৯২৫ সালে নবাবগঞ্জ শহরে স্থানান্তর করা হয়। সে সময় থেকেই ‘নবাবগঞ্জ’ শহর ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেভাবে
আমের রাজধানী
১৯৮৪ সালে একটি একক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে গড়ে উঠেছে এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমের বাজার। প্রাকৃতিকভাবে সুপ্রাচীনকাল থেকে এই অঞ্চলে আমের বাগান গড়ে উঠেছে। বাগান পরিচর্যা করা এবং আম উৎপাদনের কলাকৌশল তাই এই অঞ্চলের মানুষ রপ্ত করেছে নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে। আম উৎপাদন এই পুরো প্রক্রিয়াকে ঘিরে আবর্তিত হয় এ অঞ্চলের জনমানুষের জীবনযাত্রা। গ্রীষ্মকালে জেলার অধিকাংশ জমিতে বিভিন্ন ধরনের আম ভরপুর থাকে। এ সময় পাকা আমের সুমিষ্ট ঘ্রাণ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাকে ‘আমের রাজধানী’ হিসেবে দেশব্যাপী করেছে সুপরিচিত। ফলটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অর্থনীতির প্রধান উৎস। এরপর থেকে অনেকে এ জেলাকে ‘আমের রাজধানী’ বলেই জানে।
আমের জাতসমূহের পরিচিতি
আম একটি সুস্বাদু ও অত্যন্ত জনপ্রিয় পুষ্টিকর ফল। পৃথিবীতে আমের ইতিহাস অনেক প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। আমকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, রচিত হয়েছে গল্প, কবিতা এবং উপন্যাস। প্রধান প্রধান আম উৎপাদনকারী জেলার অর্থনীতি ও মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থাও আমের উপর নির্ভরশীল। আমের মৌসুমে আম উৎপাদন এলাকার ৯০-৯৫ ভাগ মানুষ আমের উৎপাদন, সংগ্রহ, বাজারজাতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির সঙ্গে জড়িত থাকে। আমের উৎপত্তি স্থান হিসেবে বাংলাদেশের দক্ষিণাংশের চট্টগ্রামের পাহাড়িয়া অঞ্চলকে ধরা হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কত প্রজাতির আম রয়েছে তার সঠিক হিসেব এখনও প্রকাশ পায়নি। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা ও গবেষণা প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, এ দেশে প্রায় ৮০০ ধরনের আম রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত হয়েছে ৪২টি উন্নত আমের জাত। এ সকল জাতগুলোর নামকরণও হয়েছে ভিন্নভাবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে উদ্ভাবিত জাতগুলোর নামকরণ করা হয় বারি আম-১, বারি আম-২ এইভাবে বারি আম-১৭ পর্যন্ত। আবার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ হতে উদ্ভাবিত জাতগুলোর নামকরণ এফটিআইপি বাউ ম্যাংগো-১ (শ্রাবণী), এফটিআইপি বাউ ম্যাংগো-২ (সিন্দরী) এইভাবে করা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে
উৎপাদিত আম
দেশে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ৮০০ ধরনের আমের মধ্যে প্রায় ৩৫০ ধরনের আম উৎপাদন হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। এই জেলায় বসবাসকারী মানুষের ৮০-৮৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। জেলায় উৎপাদিত ৩০০ প্রজাতির আমের মধ্যে ফজলি, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি, আশ্বিনা, বোম্বাই অন্যতম। জেলায় সবচেয়ে বেশি আম উৎপন্ন হয় শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীর গর্বের চার জিআই পণ্য
খিরসাপাত : খিরসাপাত জাতের আমটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আবেদন করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এরপর ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় এটি। আমটি গোল ও মাঝারি আকৃতির। রসাল আমটির মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি আঁশহীন। আর গন্ধ বেশ আকর্ষণীয়। খিরসাপাত আম স্বাদে খুব মিষ্টি। ফলের খোসা সামান্য মোটা, তবে আঁটি পাতলা। সাধারণত জুন মাসের শুরু থেকে আম পাকা শুরু করে। এই আমের ফুল আসা থেকে ফল পরিপক্ব হতে দরকার হয় চার মাস।
ফজলি আম : একই বছরের ৯ মার্চ ‘ফজলি আম’ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র। তবে ফজলি আম নিয়ে আপত্তি তোলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ফলে ফজলি আম রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ২০২২ সালের ২৯ মে। ফজলি আমের আরেক নাম ‘ফকিরভোগ’। এ ফল দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বদিকে বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে পাওয়া যায়। আমের অন্য প্রজাতির থেকে দেরিতে ফলে এই ফল। ফজলি আম দীর্ঘ এবং ঈষৎ চ্যাপ্টা। পাকা আমের খোসা কিছুটা হলুদ হয়ে ওঠে। শাঁস হলুদ, আঁশবিহীন, রসালো, সুগন্ধযুক্ত, সুস্বাদু ও মিষ্টি। খোসা পাতলা। আঁটি লম্বা, চ্যাপ্টা ও পাতলা। এই আমে শর্করার পরিমাণ ১৭.৫ শতাংশ। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বা মোটামুটি জুলাই মাসের শুরু থেকে ফজলি আম পাকে।
ল্যাংড়া আম : ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আমকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ল্যাংড়া আম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় ২০২৩ সালের ৫ জুলাই।
আশ্বিনা আম : ২০১৮ সালে ১ জানুয়ারি আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করে। ২০২৩ সালের ২৫ জুন আশ্বিনা আম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায়। অন্য সব আম গাছের সঙ্গে মুকুল আসে আশ্বিনার। তবে এ জাতের আম গাছে থাকে সাধারণত আগস্ট মাস পর্যন্ত। কিছু কিছু এলাকায় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আম পাওয়া যায়।
মহারাজা ‘ল্যাংড়া’
সুস্বাদু ফল আমের প্রজাতির কোনো শেষ নেই। বাহারি সব রঙ, আকার, আর স্বাদে ভরপুর আম ফলের রাজা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজার মধ্যেও তো মহারাজা থাকতে হয়। আর আমের এ মহারাজা হচ্ছে ল্যাংড়া। চাঁপাইনবাবগঞ্জে উৎপাদিত আমগুলোর মধ্যে স্বাদ-গন্ধ ও পুষ্টিমানের দিক দিয়ে সব থেকে এগিয়ে আমের মহারাজা ‘ল্যাংড়া’ আম। বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভূমিরূপ ও জলবায়ুর কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জে উৎপাদিত ল্যাংড়া আম আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, ভারতের বেনারসে ল্যাংড়া আমের উদ্ভব হয়েছে। ফলে আমটিকে অনেকেই বারানসী আম বলে থাকেন। আমের এ বিখ্যাত জাতটি বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে চাষ করা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ল্যাংড়া আমের চাষাবাদ হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাটি ও আবহাওয়া এ আমের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।
প্রচলিত আছে, ভারতে আঠারো শতকে এক খোঁড়া ফকির সুস্বাদু এই আমের চাষ করেন। সেই ফকিরের পায়ে একটু সমস্যা ছিল। ফকিরের আস্তানা থেকে এই জাতটি প্রথম সংগৃহীত হয়েছিল। খোঁড়া ফকির যেখানে বাস করতেন তার আশপাশে শত শত আমের গাছ ছিল। সেখান থেকে ল্যাংড়া নামের অতি উৎকৃষ্ট জাতটি বেরিয়ে এসেছে। তখন থেকে খোঁড়া ফকিরের নামে আমটির নামকরণ হয়েছে। সেই থেকে এই আমের নাম হয়ে যায় ‘ল্যাংড়া’। এ আম পাকার পর খানিক হলদে রঙের হয়। ফলের শাঁস হলুদাভ। কাঁচা অবস্থায় আমের গন্ধ পাগল করা। অত্যন্ত রসাল এই ফলটির মিষ্টতার পরিমাণ গড়ে ১৯.৭%। বোঁটা চিকন ও আঁটি অত্যন্ত পাতলা। পোক্ত হবার পর সংগৃহীত হলে গড়ে ৮-১০ দিন রাখা যায়। জুলাই মাসের দিকে এই আম পাকতে শুরু করে এবং বাজারে পাওয়া যায়। এই আমকে ছোট ছোট টুকরো করার ক্ষেত্রে আদর্শ বলে মনে করা হয়। এছাড়া আম থেকে তৈরি খাদ্যের ক্ষেত্রেও আদর্শ বলে মনে করা হয় ল্যাংড়াকে।
ল্যাংড়া আম নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম অন্যান্য আমের তুলনায় বেশি সুস্বাদু। প্রতিটি পরিপক্ব আমের প্রায় আশি শতাংশ খাদ্যাংশ থাকে। দেশিয় বাজারে এ আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ আমটি জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পেলে বহির্বিশ্বের বাজারেও ল্যাংড়া আমের চাহিদা তৈরি হবে।
চলতি মৌসুমে দু’হাজার কোটি টাকার আম বাণিজ্যের সম্ভাবনা
চলতি মৌসুমে আমের রাজধানীখ্যাত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। শুরু হয়েছে আম পাড়ার প্রস্তুতি। গুটি থেকে এখন আঁটিসহ পরিপক্ব হয়েছে ফলের রাজা আম। ফলে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষী ও ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে বাগানে বাগানে বসেছে আম পাড়া ও বাজারজাত করার ঘর।
এদিকে, আমবাজারগুলোতে আড়ৎ তৈরির কাজও চলছে পুরোদমে। এখন কবে আসবে বাজারে পাকা আম সবাই রয়েছেন সেই অপেক্ষায়। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, শীঘ্রই হবে অপেক্ষার অবসান। তবে গত কয়েক বছরের ন্যায় এবারও থাকছে না আম ক্যালেন্ডার। অর্থাৎ আম পাড়ার কোনো সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করেনি প্রশাসন। কিন্তু অপরিপক্ব আম বাজারজাত করলে কঠোরভাবে তা দমন করা হবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি বিপণন কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ৪ লাখ টন আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। গড়ে কেজি প্রতি ৫০ টাকা ধরে হিসেব করলে বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জেলায় ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর বাগানে আমের ফলন হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ১০০ হেক্টর কম। জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমবাগান রয়েছে শিবগঞ্জ উপজেলায় ২০ হাজার ১০০ হেক্টর। সবচেয়ে কম বাগান ভোলাহাট উপজেলায় ৩ হাজার ৬৩৪ হেক্টর। চলতি মৌসুমে প্রায় শতভাগ গাছে মুকুল এসেছিল। তবে আবহাওয়ার প্রতিকূলতা, বিশেষ করে খরা ও উচ্চ তাপমাত্রার কারণে গুটি কম এসেছে। ফলে আশানুরূপ ফলন না হলেও গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি আম রয়েছে বাগানে।
আমচাষী গোলাম মোস্তাফা সুমন বলেন, এবার মুকুল ভালো এসেছিল, কিন্তু গুটি কম এসেছে। খরার কারণে অনেক গুটি ঝরে গেছে। ফলন আশানুরূপ হয়নি। তবে যেসব বাগানে গুটি টিকে আছে, সেসব বাগানে থোকায় থোকায় আম ঝুলছে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বাগানে গোপালভোগসহ গুটি আম পাকার খবরও পাওয়া গেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুনজের আলম মানিক বলেন, এ বছর গাছ থেকে আম নামানোর নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। যখন আম পাকবে, তখনই নামানো যাবে। মে মাসের শেষ দিকে গোপালভোগ ও গুটি আম বাজারে আসবে।
ম্যাংগো প্রোডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান শামীম জানান, মৌসুমের শুরুতে গুটি আম ৮০০ টাকা, গোপালভোগ ২,৫০০-৩,০০০ এবং ক্ষীরশাপাত ২,০০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হতে পারে। তবে আমের সরবরাহ ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে দাম কম-বেশি হতে পারে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. ইয়াছিন আলী বলেন, এখন পর্যন্ত বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। ফলে আমের ফলন নিয়ে আমরা আশাবাদী। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
জেলার আম গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোখলেসুর রহমান জানান, ভৌগোলিক উৎপত্তিস্থল এবং সুস্বাদু আমের জন্য এ জেলা প্রসিদ্ধ। তাই বরাবরই এ জেলার চাষিরা আমের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর প্রায় তিন থেকে চার লাখ টন আম দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যকভাবে সরবরাহ করেন। এছাড়া কয়েক বছর ধরে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে জেলার আম।
রেকর্ড ২৪ কোটি আমে ফ্রুট ব্যাগিং, নিশ্চিত হচ্ছে বিষমুক্ত ফল
চাঁপাইনবাবগঞ্জে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে আমে ফ্রুট ব্যাগের ব্যবহার। এতে নিশ্চিত হচ্ছে নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম উৎপাদন। পাশাপাশি কীটনাশক ও বালাইনাশক দমনে খরচ হচ্ছে কম। গাছে গাছে থাকা ফজলি, ক্ষীরশাপাত, ল্যাংড়া, আশ্বিনাসহ বিভিন্ন জাতের আমে পরানো হচ্ছে ফ্রুট ব্যাগ। পরিপক্ব হলে গাছ থেকে আম পাড়ার পর বাজারজাত করার আগে খোলা হবে এসব ব্যাগ। এর মধ্যে দীর্ঘ এই সময়ে ব্যাগের মধ্যেই আবৃত থাকবে সুমিষ্ট আম। আমে স্পর্শ করবে না কোনো ধরনের কীটনাশক ও বালাইনাশক। আমের ওজন ১০০-১৫০ গ্রাম হলেই বেঁধে দেওয়া হয় এসব ফ্রুট ব্যাগ। এরপর পাকা পর্যন্ত ব্যাগবন্দি থাকে আম। সম্পূর্ণ বিষমুক্ত নিরাপদ আম উৎপাদন হয় এই পদ্ধতিতে।
বর্তমান সময়ে নিরাপদ আম উৎপাদনের প্রতিযোগিতা চলছে দেশব্যাপী। নিরাপদ আম উৎপাদন ছাড়াও আমের বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়ানো, কৃষকদের কীটনাশক প্রয়োগ বাবদ খরচ কমানো ও বিদেশে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের লক্ষ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতি বছর বাড়ছে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ব্যবহার। শতভাগ নিরাপদ আম উৎপাদনের উপায় হওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ফ্রুট ব্যাগিং। জেলায় চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ প্রায় ২৪ কোটির বেশি আমে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে।
ফ্রুট ব্যাগ ব্যবহারের ফলে বছরে অন্তত ৮-১০ বার আমে কীটনাশক ও বালাইনাশক দমনে স্প্রে খরচ কমছে। এ ছাড়াও এতে আমের বাহ্যিক সৌন্দর্য ভালো হওয়ায় ভালো দাম পেয়ে খুশি কৃষকরা। পোকামাকড় দমনে কীটনাশকের মাধ্যমে পরিচর্যার বিকল্প হিসেবে দেশের বাজারে এ পদ্ধতির আমের চাহিদা থাকায় বিক্রি বাড়ে। আমদানি করা ব্যাগের প্রায় পুরোটাই আসে বিদেশ থেকে। অভিযোগ রয়েছে, আমচাষিদের চাহিদাকে পুঁজি করে নিম্নমানের ফ্রুট ব্যাগ বাজারজাত করে সাধারণ কৃষকদের ঠকায় মধ্যস্বত্বভোগিরা।
কৃষকদের দাবি, ফ্রুট ব্যাগ ও তার কাঁচামালকে প্রকৃত কৃষিজাত পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে বেশি হারে বাজার মনিটরিং করার। এতে একদিকে যেমন নিরাপদ আম উৎপাদন নিশ্চিত সম্ভব হবে, তেমনি অন্যদিকে লাভবান হবে আমচাষি, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকরা। বর্তমানে ফ্রুট ব্যাগ কৃষিপণ্য ঘোষণা না হওয়ায় বাজার মনিটরিং করতে পারছে না কৃষি বিভাগ।
শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক ইসমাঈল খান শামীম জানান, ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত আম বিদেশে রপ্তানিযোগ্য ও শতভাগ নিরাপদ। কিন্তু অনেক সময় বাজারে থাকা মানহীন ব্যাগের কারণে তা সম্ভব হয় না। আমের ওজন ১০০ গ্রাম হলেই আমে ব্যাগ পরানো হয়। এতে কৃষক অন্তত ১০-১২ বার কীটনাশক প্রয়োগের হাত থেকে রক্ষা পায়। এ ছাড়াও ব্যাগিং করা আম আকর্ষণীয়, দাগহীন ও পুরোপুরি কীটনাশকমুক্ত হয়। তাই আমচাষি, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক ও ভোক্তার স্বার্থে ফ্রুট ব্যাগিংকে কৃষিপণ্য ঘোষণা করা প্রয়োজন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব (আম) গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোশাররফ হোসেন জানান, আমের ওজন ৬০-১০০ গ্রাম হলে ফ্রুট ব্যাগ করার উপযুক্ত সময়। এতে ব্যাগিং করা আমটি বেশি পরিমাণে হলুদ রঙ ধারণ করে। তবে আম ফ্রেশ রাখতে চাইলে ৫০ গ্রাম ওজনের সময় ফ্রুট ব্যাগিং করতে হবে। কৃষক ভাইয়েরা সাধারণ রোগবালাই-ছত্রাক দমন করতে ১২-১৫ কীটনাশক-ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে। কিন্তু ফ্রুট ব্যাগিং করার ফলে আর কোনো কীটনাশক-ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে না এবং খরচও অনেক কমে যাবে। এমনকি আমগুলো পাকার পর পেড়ে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক ছাড়াই সংরক্ষণ করা যাবে ৯ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত। এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও জানান, আম পরিপক্ব হওয়ার আগে-পরে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়। এতে আমের গায়ে ছত্রাক দেখা দেয়। ফ্রুট ব্যাগিং করলে তা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ ধরনের কাগজের এই ব্যাগে দু’টি আস্তরণ রয়েছে। বাইরের আস্তরণটি বাদামি রঙের, আর ভেতরেরটি কালো রঙের।
এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমের বাজার ‘কানসাট’
সহায়ক আবহাওয়া ও উর্বর মাটির সুবাদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষাবাদ হয় সুস্বাদু ফল আমের। দেশজুড়ে আমের সর্ববৃহৎ যোগানদাতা হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এই জেলারই কানসাট নামের ইউনিয়নে বসে বাংলাদেশের বৃহত্তম আমের বাজার। আগে এই অঞ্চলটির নাম ছিল ‘কংসহট্ট’। এখানকার রাজবাড়িটিকে স্থানীয়রা বলতো কুঁজো রাজার বাড়ি। ইতিহাসবিদদের মতে, এই কংসহট্ট কালের বিবর্তনে বদলে বর্তমান ‘কানসাট’ নাম পেয়েছে।
দেশের সর্ববৃহৎ আমের বাজারটি বসে এই কানসাটে। শুধু বাংলাদেশের বৃহত্তম বাজারই নয়, কানসাট গোটা এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আম বাজার। ছোট-বড়-মাঝারি সব মিলিয়ে এখানে প্রায় আড়াইশ’ আড়তে দিনভর চলে আমের বেচা-কেনা। চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আড়তদাররা আম কিনতে এখানে চলে আসেন। প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমজমাট থাকে এই হাট। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যত্র অনেকগুলো আমের হাট থাকলেও পাইকারী বাজারের জন্য কানসাটই সবচেয়ে বড় ও প্রসিদ্ধ।
আমের ভরা মৌসুমে প্রতিদিন শতশত ট্রাক এখান থেকে আমভর্তি হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের উদ্দেশে রওনা হয়। শুধু এই কানসাটেই প্রতিদিন গড়ে প্রায় চার কোটি টাকার আম বেচা-কেনা হয়। আমের হাট সাধারণত মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে জুলাই মাস পর্যন্ত চলে। জুন মাসে হাট পুরো জমে উঠে। সকালে সারাটা বাজার শুধু সবুজে ভর্তি থাকে, অর্থাৎ প্রত্যেক ঝুড়িতে থাকে কাঁচা আমের পসরা। কিন্তু বিকেলের দিকে গোটা হাট রঙিন হয়ে ওঠে অর্থাৎ বিক্রির জন্য নিয়ে আসা সব আম পেকে যায়। এ সময় হাটের যেদিকে যাওয়া হয় সেদিকেই আমের গন্ধে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সেই সঙ্গে স্বাদে বেশ রসাল হয়ে ওঠে কানসাটের আমগুলো।
ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের পর আম যাবে এবার চীনের বাজারে
ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের পর চীনের বাজারে প্রথমবারের মতো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে দেশের আম রপ্তানির। এতে খুশি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম রপ্তানিকারক, বাগান মালিক ও উদ্যোক্তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রার নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে আম। আর কৃষি বিভাগ বলছে, আম রপ্তানির বাধাগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনে কাজ চলছে। বিগত কয়েক বছর ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে আম রপ্তানি হয়। এ বছর চীনের বাজারে দেশের আম রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ইতোমধ্যে জেলার কয়েকটি আমবাগান এবং আম গ্রেডিং, শর্টিং ও শোধন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন চীন আমদানিকারকদের প্রতিনিধি দল। পরিদর্শন শেষে তারা আম আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেন। এতে খুশি বাগান মালিক ও উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে আম কিনতে আগ্রহী চীন। এটা উদ্যোক্তাদের জন্য খুশির খবর। কোনোরকম মাধ্যম ছাড়া সরাসরি বাগান থেকে চীনে আম রপ্তানি করতে পারলে নিশ্চিত হবে ন্যায্যমূল্য।
রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস কৃষি বিভাগের। শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নয়ন মিয়া বলেন, কৃষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আম রপ্তানিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. ইয়াছিন আলী বলেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে যে ধরনের বাধা-বিঘ্ন রয়েছে, সেগুলো দূর করে রপ্তানি বাড়াতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
জাহিদ হাসান মাহমুদ মিম্পা
চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্যানেল