
মুন্নি ক্লাস থ্রিতে পড়ে। বয়স মাত্র আট বছর। সে খুবই চঞ্চল, হাসিখুশি আর কৌতূহলী এক মেয়ে। তবে তার সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি একটু অন্যরকম- একটি সাদা, নাদুসনুদুস ছাগল, নাম চিকু। বাবা কুরবানি ঈদের এক মাস আগে হাট থেকে চিকুকে কিনে এনেছিলেন। হাট থেকে ফিরে বাবা বলেছিলেন, ‘এটা কোরবানির ছাগল। ভালো করে খাওয়াতে হবে, যাতে ঈদের দিন ভালো হয়।’ কিন্তু সেই থেকেই মুন্নির মন কেমন যেন হয়ে গেল।
প্রথম দিনই চিকু তার দিকে তাকিয়ে কাঁ-কাঁ করে ডেকে উঠেছিল। মুন্নির মনে হয়েছিল, ‘ও বুঝি আমাকে কিছু বলতে চাইছে!’ এরপর থেকেই দু’জনের অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।
মুন্নি প্রতিদিন সকালে-বিকেলে চিকুকে গোসল করাত, ঘাস খাওয়াত, গলায় রঙিন ফিতা পরাত, আর নিজ হাতে তাকে আদর করে খড় বিছিয়ে দিত। স্কুল থেকে ফিরেই সে সোজা দৌড়ে চিকুর কাছে চলে যেত।
চিকুও যেন তাকে চেনে। মুন্নিকে দেখলেই লাফিয়ে ওঠে, লেজ নাড়ে, মাথা ঠেকিয়ে দেয় তার গায়ে। ওরা যেন একে অপরের ভাষা বোঝে- এক অদ্ভুত, মায়াভরা বন্ধুত্ব।
তবে যত দিন যাচ্ছে মুন্নির মনটা আরও বেশি আঁকড়ে ধরছে চিকুকে। একদিন সে মাকে বলেই ফেলল, ‘মা, আমি কিন্তু কোরবানির সময় চিকুকে দিতে দেব না। ও তো আমার বন্ধু!’
মা তাকে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘মা, কোরবানি মানে হলো ত্যাগ। আল্লাহর জন্য আমরা আমাদের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করি, যেন বুঝিয়ে দিই- তাঁর জন্য আমরা সব কিছু ছাড়তে পারি।’
মুন্নি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। রাতে ঘুমাতে গিয়ে সে চিকুর পাশে গিয়ে বসে কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, ‘চিকু, আমি তোকে ছাড়তে চাই না। কিন্তু আল্লাহ যদি তোর মতো ভালো কিছু দিয়ে দেন?’
পরদিন স্কুলে হুজুর ক্লাসে কোরবানির অর্থ বোঝালেন। তিনি বললেন, ‘কোরবানি শুধু পশু জবাই নয়, এটা আমাদের ভেতরের লোভ, অহংকার আর প্রিয় জিনিসের জন্য ত্যাগ শেখার বড় সুযোগ। যদি আমরা প্রিয় কিছু আল্লাহর জন্য দেই, তিনি আমাদের আরও বড় কিছু দিয়ে দেন।’
এই কথা শুনে মুন্নির মনটা যেন একটু হালকা হলো। সে ভাবল, যদি আল্লাহ চিকুর চেয়েও ভালো কিছু দেন!
অবশেষে ঈদের দিন এল। সকালে সবাই নতুন জামা পরে নামাজে গেল। মুন্নি চুপচাপ ছিল। নামাজ শেষে যখন কুরবানি শুরু হলো, তখন সে চিকুর গলায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘তুই আমার সবচেয়ে প্রিয়। আজ তোকে আল্লাহকে দিচ্ছি, কারণ আমি তোকে সত্যিই ভালোবাসি।’
চিকু তাকে চেয়ে চেয়ে দেখল। তারপর সে ধীরে ধীরে চলে গেল কোরবানির জায়গায়। মুন্নির চোখে জল এসে গেল। কিন্তু সে চিৎকার করল না, কান্না চেপে রাখল। কারণ সে জানে, এটি তার এক মহান কাজ।
সন্ধ্যাবেলা মুন্নি চুপচাপ বসে ছিল বারান্দায়। হঠাৎ সে দেখল বাবা একটি নতুন ছাগল নিয়ে ঢুকলেন উঠানে। ছাগলটির গায়ের রং কালচে, কিন্তু চোখে চিকুর মতোই মায়া।
মা বললেন, ‘তোমার মামা তোমার জন্য এটা পাঠিয়েছেন। ঈদের উপহার।’
মুন্নি দৌড়ে গিয়ে ছাগলটার গলা জড়িয়ে ধরল। খুশিতে বলে উঠল, ‘এ তো চিকুর ভাই মনে হয়! আমি এর নাম রাখব- চিকু টু!”
সে রাতে মুন্নি বুঝতে পারল, ত্যাগের মধ্যেই আছে ভালোবাসার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। আর ভালোবাসা কখনো হারিয়ে যায় না- তা ফিরে আসে অন্য রূপে, নতুন আশায়।
এভাবেই ঈদের দিনটি হয়ে উঠল মুন্নির জীবনে এক বড় শিক্ষার দিন- আনন্দ, ত্যাগ আর ভালোবাসার মিলনমেলা।
প্যানেল