ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সরকারকে আর সময় দেবে না বিএনপি

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:২১, ৩১ মে ২০২৫

সরকারকে আর সময় দেবে না বিএনপি

প্রায় ১৯ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে

প্রায় ১৯ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। অনুকূল পরিবেশ পেয়েও ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করতে পারছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। তাই সরকারকে আর সময় না দিয়ে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে কঠোর চাপে ফেলতে চায়। আপাতত নরমে-গরমে চাপ অব্যাহত রাখলেও জুলাই সনদ ঘোষণার পর কঠোর চাপে ফেলবে। জনমত তৈরি করতে সক্রিয় নেতাকর্মীরা। যাবতীয় কর্মকৌশল ঠিক করার জোর প্রস্তুতি চলছে। 
সূত্র জানায়, দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বিএনপির ‘টপ টু বটম’ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখলেও এখনই কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে না। নরমে-গরমে বক্তব্য রেখে সোচ্চার থাকবেন তারা। তবে সরকার কি করে আরও কিছুদিন দেখতে চায়। সরকারকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে আপাতত সভা-সমাবেশে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবি করার পাশাপাশি রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া হচ্ছে। জুলাই সনদ ঘোষণার পর সমমনা সব রাজনৈতিক দল নিয়ে সরকারকে কঠোর চাপে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ না পেলে সরকারের বিরুদ্ধে কর্মসূচি পালনের বিষয়ে দলের অভ্যন্তরে প্রাথমকি সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের পরামর্শে বিএনপি হাইকমান্ড ওই অবস্থান থেকে সরে আসে।
প্রায় ১৯ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ে বিএনপি। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর বিএনপির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। অভিজ্ঞ মহলের মতে, দেশে এখন নির্বাচন হলেই বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম হবে। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে দীর্ঘদিন আন্দোলনের পর অনুকূল পরিবেশ পেয়ে এখন পুরোদমে নির্বাচনের জন্য সোচ্চার দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি প্রায় ১০ মাস ধরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি লাগাতারভাবে জানিয়ে আসলেও অন্তর্বর্তী সরকার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেন বিএনপির চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। এ সময় দলের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দাবি করা হলেও প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না দিয়ে আগের মতোই জানান, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। এতে বিএনপি ক্ষুব্ধ হয়।

অতি সম্প্রতি জাপান সফরে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেন, বাংলাদেশে শুধু একটি দল নির্বাচন চায়। এরপর বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করতে দলীয় হাইকমান্ডকে চাপ দেয়। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের কাছে সিনিয়র নেতাদের মাধ্যমে বার্তা দেন, তারা যেন আপাতত ধৈর্যধারণ করেন। যখন আন্দোলনের প্রয়োজন হবে তখন নেতাকর্মীদের জানানো হবে। 
সূত্র মতে, বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে আপাতত সরকারকে নির্বাচনের রোডম্যাপের বিষয়ে চাপে রাখা হলেও কঠোর অবস্থান থেকে বিরত থাকছে বিএনপি। তবে দ্রুত নির্বাচনের দাবি থেকে বিএনপি পিছু হটবে না। এ জন্য সরকারের ওপর চাপ বৃদ্ধি করতে জুলাই মাসের শুরু থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে রাজপথে নিয়মতান্ত্রিক কিছু কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মানববন্ধন, সেমিনার, আলোচনা সভা, সমাবেশ, পদযাত্রা, গণমিছিল, গণঅবস্থান এবং মার্চ ফর ডেমোক্রেসি। সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকেও যুগপৎ এসব কর্মসূচি পালন করতে বলা হবে। এছাড়া দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের সহযোগিতা চাওয়া হবে। এরপর কিছুদিন সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জুলাই সনদ ঘোষণার পর সরকারকে কঠোর চাপে ফেলা হবে। 
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, আমরা দেখতে চাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার বিষয়ে সরকার কি করতে চায়। আমাদের প্রত্যাশা অনুসারে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করা হলে দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা আমাদের করণীয় ঠিক করব। তবে আমরা চাই সরকার ডিসেম্বরের মধ্যেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। সংস্কার ও বিচারের জন্য নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে না। 
সংস্কারসহ রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় সার্বিক বিষয় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই সনদ ঘোষণা করবে। এ বিষয়ে সম্প্রতি একজন মার্কিন সিনেটরের সঙ্গে আলাপকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জুলাই সনদ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথনির্দেশ করবে। 
সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত মতামত নেওয়ার পর ২০ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ৩০টির বেশি দলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে সংবিধানের মূলনীতি, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য এবং মেয়াদ, এক ব্যক্তির একাধিক দায়িত্ব পালন, সংবিধান সংশোধন, গণপরিষদ নির্বাচন ও সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। এর মধ্যে প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে নানা মত। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে সংস্কারের অনেক বিষয়েই রাজনৈতিক দলগুলো একমত পোষণ করবে বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। 
আর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, এ বছর জুলাই মাসেই তৈরি হবে জুলাই সনদ। এমন লক্ষ্য নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শীঘ্রই দ্বিতীয় দফা আলোচনা শুরু করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আলোচনার মধ্য দিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসছে দলগুলো। বিচার বিভাগসহ কিছু জায়গায় এরই মধ্যে প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

জাতীয় সনদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করা। আমরা এ সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে নাগরিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি চুক্তি সইয়ের চেষ্টা করছি, যাতে নাগরিকরা দলগুলোকে দায়বদ্ধ করতে পারেন।
বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, কোনো কারণে ডিসেম্বরে নির্বাচন  না হলে, আগামী বছর জুনেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। কারণ, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরু, তারপর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং শুরু হবে বর্ষাকাল। তাই আবহাওয়াগত কারণে এ সময় দেশে নির্বাচনের পরিবেশ থাকবে না। এ ছাড়া নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, দেশে তত সংকট বাড়বে। তখন কোনো কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, ভোটের পরিবেশ বিঘিœত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে।   
দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি পালনসহ প্রয়োজনীয় কৌশল নির্ধারণে ইতোমধ্যেই সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। প্রয়োজনে ঈদের পর আবারও ওই দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গেও বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা যায়। 
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো সংস্কার করতে চাইলে, বিএনপি তাতে সায় দেবে না বলে সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠককালে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করতে চাইলেও বিএনপি এর বিরোধিতা করবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদসহ অনেক প্রস্তাবে আপত্তি জানানো হয়। সংবিধানের সংশোধনীর জন্য গণভোট প্রযোজ্য নয় বলেও দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না এবং প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হতে পারবে না, এসব বিষয়েও বিএনপি আপত্তি জানিয়েছে। সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের বিষয়েও বিএনপি আপত্তি করেছে বলে জানা যায়। 
জানা যায়, বিএনপি হাইকমান্ড মনে করছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধান সংশোধনসহ যেভাবে বিপুল সংখ্যক সংস্কার কাজ করতে চাচ্ছে, তাতে সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। তাই জুলাই সনদ ঘোষণার আগেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিকভাবে বিএনপি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবি করে আসছে। এ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা সরকারকে চাপে রাখতে চায়।  সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আসছে জুলাই মাসেই জুলাই সনদ ঘোষণা করা হবে। তাই জুলাই সনদ ঘোষণার পর সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলে বিএনপি সরকারকে কঠোর চাপে ফেলার চেষ্টা করবে। এ জন্য রাজপথে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি পালনের জন্যই তাদের প্রস্তুতি রয়েছে। 
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে ইতোমধ্যেই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের বার্তা দিয়েছেন। তাই সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এখন নিজ নিজ এলাকায় অধিকতর সক্রিয় হয়েছে বলে জানা যায়। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের দলীয় কর্মসূচিগুলোতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিভিন্ন ভাবে নিজের অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সেইসঙ্গে গণসংযোগ কর্মসূচিও জোরদার করছেন।  
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জনকণ্ঠকে জানান, দ্রুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তেমন আগ্রহ আছে বলে বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন না। তাই দলের নেতাকর্মীরা এখন নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। তবে ঈদের পর থেকে আস্তে আস্তে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি নিয়ে আরও সোচ্চার হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সংস্কারসহ দেশের সার্বিক বিষয়ে সরকার জুলাই সনদ ঘোষণা করবে। এটি জুলাই মাসেই ঘোষণা করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তাই জুলাই সনদে কি থাকবে, তা দেখার জন্য বিএনপি অপেক্ষা করছে। এরপর দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে কঠোর চাপে ফেলতে যা যা করণীয়, দলের পক্ষ থেকে তাই করা হবে।

আরো পড়ুন  

×