
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা ফরিদপুর। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এই শহরের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস ও গৌরবময় ঐতিহ্য। মুঘল আমলে ফতেহাবাদ নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি পরে সুফি সাধক শাহ ফরিদ (রহ.)-এর নামে নামকরণ পায় “ফরিদপুর” নামে। পদ্মার কোল ঘেঁষা এই শহরটি একসময় ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা শান্ত এক জনপদ। কালের পরিক্রমায় তা এখন এক ব্যস্ত, ঘনবসতিপূর্ণ এবং অনেকাংশে অপরিকল্পিত শহরে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আধুনিক জীবনযাপনের প্রয়োজনে শহর হিসেবে ফরিদপুর কতটা বাসযোগ্য? নাগরিকদের শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, যাতায়াত, কর্মসংস্থান ও পরিবেশ—এই সবকিছুর মধ্যে ফরিদপুর কতটা এগিয়েছে বা পিছিয়ে রয়েছে, তা বিশ্লেষণ করাই এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য।
ফরিদপুর শহরের অন্যতম ইতিবাচক দিক হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের তুলনামূলক উন্নতি। এখানে রয়েছে এক হাজার শয্যার ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, যা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য চিকিৎসাকেন্দ্র। এর পাশাপাশি রয়েছে আধুনিক সরকারি সদর হাসপাতাল এবং বেশ কিছু বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
শিক্ষাক্ষেত্রেও ফরিদপুর শহরটি বেশ অগ্রসর। ফরিদপুর জিলা স্কুল, ফরিদপুর মহিলা কলেজ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ—এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার মান বজায় রেখে দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে শিক্ষাদান করে যাচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ফরিদপুর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট—যা প্রযুক্তিগত শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও মানের দিক থেকে অনেক ক্ষেত্রেই ঘাটতি রয়েছে। চিকিৎসাক্ষেত্রেও প্রায়শই ওষুধের সংকট, ডাক্তার ও নার্সের ঘাটতি, সরকারি হসপিটাল গুলিতে দালালদের দৌরাত্ম্য এবং দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ উঠে থাকে।
ফরিদপুর জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা সময়ের সাথে উন্নত হলেও, এখনও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। এই ভাঙাচোরা রাস্তাগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের চলাচলে মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি করছে। ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলা শহরে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ভাঙ্গা-ফরিদপুর মহাসড়কের অবস্থা খুবই নাজুক। রাস্তায় বড় বড় গর্ত আর ভাঙ্গা চোরার কারণে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। দ্রুত এই সড়কটির সংস্কার করা না হলে, এটি ফরিদপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
ফরিদপুর শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা হল অতিরিক্ত জনসংখ্যা। ২০০৯ সালে পৌরসভার জনসংখ্যা ছিল ১,৩৫,৮৩৭ জন, যা প্রতি বছর গড়ে ৩.৯১% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধারণা করা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে শহরের জনসংখ্যা বেড়ে ৩,২১,৯২২ জনে পৌঁছাবে।
জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি শহরের অবকাঠামোর ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে। রাস্তাঘাট ও বাজার এলাকাগুলোতে সারাক্ষণ ভিড় লেগেই থাকে, ফলে পথচারীদের চলাচলে অসুবিধা হয়। বিশেষ করে, সরু রাস্তা ও বেহাল সড়ক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে জনবহুল এলাকায় চুরি ও পকেটমারের ঘটনা ঘটে, যা নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন নির্জন স্থানে পর্যাপ্ত লাইট ও সিসি ক্যামেরা না থাকার প্রায়ই ছিনতাইয়ের মত ঘটনা ঘটছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও নগর ব্যবস্থাপনার উন্নতি না হলে ফরিদপুর শহরের বাসিন্দাদের ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে।
ফরিদপুর শহরের মধ্যে চলাচলের প্রধান মাধ্যম রিকশা বা থ্রি হুইলার অটো। তবে যাত্রীর তুলনায় এসব যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেশি। অতিরিক্ত অটোরিকশার কারণে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যেমন—জনতার মোড়, ভাঙ্গা রাস্তার মোড়, রেফেলসের মোড়, আলিপুর গোরস্তান, সদর হাসপাতাল রোড, টেপাখোলা গরুর হাট রোড ও মেডিকেল কলেজ রোডে দিনের অধিকাংশ সময় যানজট লেগে থাকে। ফলে পথচারী ও যানবাহন চলাচলে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। যানজট নিরসনে সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আগামী দিনে ফরিদপুর শহরের চলাচল ব্যবস্থা আরও সংকটাপন্ন হতে পারে।
এছাড়াও শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বেড়েছে ভ্রাম্যমাণ হকারদের দৌরাত্ম্য। শহরের প্রাণকেন্দ্র জনতার মোড়ে ফুটপাত ও সড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ভ্রাম্যমান দোকানপাট। যা যানজট এবং পথচারীদের চলাচলের সমস্যার অন্যতম কারণ। এছাড়াও কুমার নদীর উপর নির্মিত বেইলি ব্রিজও ভ্রাম্যমাণ হকারদের দখলে। হকারদের পুনর্বাসন এবং বিকল্প জায়গা না থাকায় প্রশাসনের সদিচ্ছা সত্ত্বেও এ সমস্যার দীর্ঘস্থায় কোন সমাধান হচ্ছে না।
ফরিদপুর শহরের অন্যতম বড় পরিবেশগত সমস্যা হলো বায়ু ও শব্দ দূষণ। সিএনবি ঘাটে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে প্রধান সড়কগুলো ধুলায় আচ্ছন্ন। বালুবোঝাই ট্রাকগুলোর অতিরিক্ত চলাচল রাস্তাকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তেমনি সৃষ্ট ধুলাবালি ও শব্দ শহরবাসীর জন্য তৈরি করছে শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি ও হৃদরোগের ঝুঁকি।
নগরের যত্রতত্র অপরিকল্পিত বর্জ্য ফেলা, ডাস্টবিনের অভাব, এবং পৌরসভার অব্যবস্থাপনা শহরের সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্যঝুঁকি—দুই দিক থেকেই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজার, হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকায় প্রতিদিন জমে থাকে ময়লার স্তূপ, যার থেকে ছড়ায় দূষণ ও দুর্গন্ধ।
ফরিদপুর শহরের অন্যতম অবহেলিত সমস্যা হলো সুপেয় পানির তীব্র সংকট। কিছু সুগভীর নলকূপ থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পৌরসভার সরবরাহকৃত পানিতে অতিরিক্ত আয়রন থাকায় তা খাওয়া তো দূরের কথা, গোসল করাও সম্ভব নয়। ফলে অধিকাংশ মানুষ নির্ভর করছেন বোতলজাত পানি বা ফিলটার ব্যবস্থার ওপর, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ব্যয়বহুল।
ফরিদপুরে তেমন বড় শিল্প কারখানা নেই বললেই চলে। এজন্য প্রথাগত পেশার বাইরে এখানকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও তাই বেশ সীমিত। হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, শিক্ষক, আর চিকিৎসক ছাড়া বেশিরভাগ মানুষই এখানে নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পড়েন।
যানজট নিরসন, রাস্তা সংস্কার, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারকরণ, পরিকল্পিত নগরায়ণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ফরিদপুর শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান আরও অবনতি হতে পারে। প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ, নাগরিক সচেতনতা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে ফরিদপুরকে আরও বাসযোগ্য শহরে পরিণত করা সম্ভব।
সজিব