ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১

মাতৃভূমি মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা

ফনিন্দ্র সরকার

প্রকাশিত: ১৯:৫৯, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মাতৃভূমি মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা

ফেব্রুয়ারি মাসকে আমরা ভাষার মাস হিসেবে চিহ্নিত করে আসছি। এর যুক্তি হচ্ছে ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে কয়েকজন ভাষাসৈনিক জীবন দান করেন। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান। সে সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ছিল উর্দু। বাঙালি অধ্যুষিত এ অঞ্চলের মানুষ এটাকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আন্দোলন গড়ে ওঠে। সে আন্দোলন এক সময় তীব্র আকার ধারণ করে। রাজপথে মিছিল-সমাবেশের ঐতিহাসিকতায় বাঙালির সাহসের বিষয়টি স্থান পায়। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনও বেগবান হতে থাকে। সেই আন্দোলনের সফল পরিণতি লাভ করে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস, রক্তঝরা ইতিহাস- এ ইতিহাস কমবেশি সকলেই জানে। তাই আমি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসের মর্যাদা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার ফলে এই দিনটি সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান লাভ করেছে। এটা আমাদের জন্য বিশেষ গৌরবের। এই দিবসকে কেন্দ্র করে বহু বছর ধরে পত্রিকায় কলাম লিখে আসছি। অনেক বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদও অনেক লেখা লিখেছেন। যে যার মতো করে বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা করেছেন। এ নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যেতে চাই না। বলতে চাই ভালোবাসার কথা। মাতৃভূমির প্রতি ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা।
বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাতৃভূমি নিয়ে কালজয়ী গান লিখেছেন... ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পড়ে ঠেকাই মাথা’। গানটি শুনলে হৃদয় মাঝে অন্যরকম শিহরণ জাগে। ১৯০৫ সালে লিখা এই গানটি হৃদয় মন্দিরে ঝংকার তোলে। এই গানের রচনাকালে বাংলাদেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। ডি এল রায়ের গান- ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা/ ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ও সে সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। মাতৃভূমির প্রতি এমন ভালোবাসা মাখা গান শুনতে সকলেরই ভালো লাগার কথা। আরও অনেক লেখক মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি নিয়ে কত গান, কবিতা, মিষ্টি মিষ্টি ছড়া লিখেছেন। আরও অনেক লেখা হবে। বাংলাভাষা একটি শঙ্কর ভাষা। পৃথিবীর বহু ভাষা থেকে শব্দ চয়ন করে এ ভাষাকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। মাতৃভাষা বাংলার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। বাংলা ভাষার মূল উৎস হচ্ছে প্রাকৃত ভাষা। প্রাকৃত ভাষা বলতে প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত কথাকে বোঝায়। এ ভাষাগুলো ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের ইন্দো-আর্য শাখার প্রাচীন নিদর্শন। যা হোক, এ তো ইতিহাসের কথা। ইতিহাসের কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। বাংলাভাষা মূলত পূর্বাঞ্চলীয় মধ্য-ইন্দো ভাষাগুলো থেকে উদ্ভূত ইন্দো-আর্য ভাষা। এ ভাষা বাংলার নবজাগরণের সময় ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়। উনিশ শতকের শেষভাগে মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। তদানীন্তন মুসলিম রক্ষণশীল সমাজে এ ছিল দুঃসাহসিক কাজ। মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন বেগম রোকেয়া।
যে কথা শুরুতে বলেছি, ফেব্রুয়ারি মাসকে আমরা ভাষার মাস বলে থাকি। ভাষা আন্দোলন সূচনা হয়েছিল ১৯৩৭ সালেই। পরিণতি লাভ করে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তদানের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতা লাভ করে বাংলা ভাষাকে আমরা কতটা মর্যাদা দিতে পেরেছি সে প্রশ্নটি করা যেতেই পারে। আজও ভাষা নিয়ে কতরকম বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। এক শ্রেণি এটাকে নিছকই ‘হিদুয়ানী’ ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে জাতিকে বিভাজন করার চেষ্টা চালিয়েছে। বাংলা ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের যে আত্মিক বন্ধন রয়েছে সেটাকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে দেশকে অস্বীকার করা। রক্ত দিয়ে যারা দেশ ও মাতৃভাষাকে অনন্য মর্যাদায় সিক্ত করেছেন তাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা মহাপাপের কাজ। ইদানীং উর্দুর প্রতি কারও কারও অনুরাগ দেখে বিস্মিত হই। একই সঙ্গে হই শঙ্কিতও। দেশের প্রতি মমত্ববোধ না থাকলে মানুষ্যত্ববোধ তৈরি হয় না। মনুষ্যত্বের সংস্কারে ভূমিকা রাখাও খুবই জরুরি।
বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক বন্ধনের তীর্থভূমি। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। আমরা যে যে ধর্মের অনুসারীই হইনা কেন আমরা বাংলাদেশী এবং জাতিগতভাবে বাঙালি। একই সংস্কৃতির আবহে বেড়ে উঠেছি সবাই। হিংসা-বিদ্বেষ এগুলো কোনোদিনই ছিল না, এখনো নেই। তবে কতিপয় দুষ্টচক্রের কাছে এ বন্ধনের কোনো মূল্য নেই।
সত্য সর্বদাই সর্বজনীন। আমাদের সত্যের ওপর দাঁড়িয়েই এগিয়ে যেতে হবে। মাতৃভাষাকে মর্যাদা দিয়েই দেশের প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্য অর্জন করতে হবে। অন্য ভাষায় শিক্ষা গ্রহণে বাধা নেই, কিন্তু আগে আমার মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব বিবেচনা করে কথা বলতে হবে। আমরা যখন কোনো বিদেশীদের সঙ্গে অর্থাৎ সাদা চামড়ার ইংরেজি ভাষাভাষীর সঙ্গে কথা বলি তখন নিজের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে ওই বিদেশী লোকটির ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করি। কারণ, সে আমার বাংলা ভাষা বোঝে না। আসলে আমাদের উচিত বাংলা ভাষায় কথা বলা। যে সকল বিদেশী আমাদের দেশে আসেন, আমরা ওই বিদেশী লোকটির মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্ব দেই। তার ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করি। এতে আমার দেশ, আমার মাতৃভাষার প্রতি অবিচার হয় বলে মনে করি। যদি আমরা বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দেই তবে বিদেশীরা আমার ভাষা শিখতে বাধ্য হবে। জাপানি, ইতালিয়ান ও চাইনিজ ভাষাভাষী লোকেরা নিজেদের ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলে। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। ইংরেজি ভাষা পৃথিবীর সকল দেশের জন্য একটা কমন ভাষায় পরিণত হয়েছে। এ ভাষা আন্তর্জাতিক দাপ্তরিক ভাষা। ইংরেজি ভাষার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে আমরাও ইংরেজিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ইংরেজি জানাকে গর্বের মনে করি। ইংরেজিসহ আরও বহু ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করা গৌরবের বিষয় বটে, কিন্তু যদি মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করি তবে আমাদের সব অর্জন ব্যর্থ হবে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজিতে পণ্ডিত ছিলেন। তার সময় অনেক ইংরেজও মধুসূদনের মতো ইংরেজি জানত না। ইংরেজি সাহিত্য চর্চা করতে গিয়ে তিনি হোঁচট খেয়েছিলেন। বাঙালি হওয়ার কারণে মধুসূদনের সাহিত্যকে ইংরেজরা তেমন মূল্যায়ন করতেন না। মধুসূদনের সম্বিত ফিরে। ভুল বুঝতে পেরে তিনি তার মেধাকে বাংলা ভাষায় কাজে লাগান। বিদেশে বসে আবেগঘন কবিতা লেখেন- ‘কপোতাক্ষ নদ’ এ কবিতায় তিনি দেশপ্রেম ফুটিয়ে তোলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে নবধারার প্রবর্তন করেন। রচনা করেন ‘মেঘনাদ বধ’ নামক মহাকাব্য। উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও নাট্যকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা ভাষার নবজাগরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি জাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বাংলা ভাষায় তিনিই অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও চতুর্দশপদী বা সনেটের জনক। আজকাল ক্ষমতাধিকারীদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগের ফলে বাঙালি সমাজে কতই না অন্যায়-অবিচার হয়ে চলেছে। অন্যায়-অবিচারের শত শত দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমাদের যদি সত্যিকার অর্থে দেশকে ভালোবাসার মানসিকতা তৈরি হতো তবে এত অন্যায় হতো না। সমাজে অন্যায় বৃদ্ধি পেতে থাকলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ে। সমাজে দরিদ্র থাকতে পারে, নিরক্ষর থাকতে পারে- ওগুলো রাষ্ট্রকে দুর্বল করে না। কিন্তু যদি অবিচার থাকে আর তার মাত্রা যদি বৃদ্ধি পেতেই থাকে তবে তা শঙ্কার। এর হাত থেকে রক্ষার সবচেয়ে প্রধান উপায় হচ্ছে দেশকে মাতৃজ্ঞানে ভালোবাসতে পারা আর মাতৃভাষার প্রতি দুর্বলতা থাকা। দেশ ও মাতৃভাষাপ্রেমিক ব্যক্তি কখনো অন্যায়, অবিচার ও নৈরাজ্যকে সমর্থন করতে পারে না। স্বদেশপ্রেমীরা নিয়ত স্বদেশে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অতএব, ‘মাতৃভূমি, মাতৃভাষা, আমার ভালোবাসা’ হয়ে উঠুক সর্বজনীন স্লোগান।  
 
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

×