আমাদের ধানশালিক, কিষান-কিষানি, নদী-নালা ও তরুপল্লবে ঘেরা বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বিশ্বনন্দিত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনকে ঘিরে তিন শূন্য (Three Zero) তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। এরই সারথি ধরে নতুন বিশ্ব গড়ার পথ সুগম হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এই প্রতিপাদ্য বিষয়ে বলার আগে, এর সঙ্গে অতখানি প্রাসঙ্গিক না হলেও আর্টিকেলটি প্রাণবন্ত করে তুলতে সঙ্গতকারণেই অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে শূন্য সম্পর্কে আলোকপাত করতে সচেষ্ট হয়েছি।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, আসলে সূক্ষ্মতার আড়ালে সবকিছুতেই শূন্য; আবার শূন্যেই সবকিছু (Zero in Everything & Everything in Zero)। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বস্তুর ভর (Mass) কেন্দ্র করে মহাকর্ষ ও অভিকর্ষের আওতায় প্রায় বস্তুর আকৃতি গোলাকার এবং গণিতের সার্থক অঙ্ক নয় থেকে ০ মোট অঙ্ক ১০টি। এদিকে শূন্য মাধ্যমে শব্দের বেগ ০ (শূন্য); পৃথিবীর কেন্দ্রে বস্তুর ওজন ০ (শূন্য) নিউটন; পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষজ ত্বরণ (এ) এর মান ০ (শূন্য); লন্ডনের গ্রিনিচ মান মন্দির ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমায় অবস্থিত এবং এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সময় হিসাব করা হয়। তাছাড়া এখান থেকে পূর্বদিকে গেলে যোগ এবং পশ্চিমে গেলে সময় বিয়োগ হবে। পৃথিবীর পরম তাপমাত্রা হচ্ছে ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২৭৩ শ’ (কেলভিন); বরফের গলনাঙ্ক সেলসিয়াস স্কেলে শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড; পরম তাপমাত্রায় গ্যাসের আয়তন ০ (শূন্য); কম্পিউটারের আইকিউ হচ্ছে ০ (শূন্য); মূল মধ্যরেখার মান ০ (শূন্য); আদর্শ গ্যাসের অভ্যন্তরীণ শক্তি ০ (শূন্য); নিরক্ষরেখার অক্ষাংশ ০ (শূন্য ডিগ্রি); দুটি সন্তান জন্মের অর্থ হলো প্রকারান্তরে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার- ০ (শূন্য); ভূপৃষ্ঠের বিভব শক্তি ০ (শূন্য); আদর্শ ট্রান্সফর্মারের ক্ষরণ ০ (শূন্য) এবং সমবেগ চলমান বস্তুর ত্বরণ ০ (শূন্য)। আসলে শূন্যর মাহাত্ম অনেক, যা বলে শেষ করা যাবে না। মূলত সংখ্যা লিপিতে শূন্য তথা জিরো (Zero) হলো বিস্ময়কর অঙ্ক বা ডিজিট। বিধায় বিজ্ঞান জগতে উন্নতির পেছনে কম্পিউটারের ক্ষেত্রে ১ (এক) সম্পূরক হিসেবে কাজ করে, তা হলো শূন্য (০)। এই শূন্যের তাৎপর্য শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস মনেপ্রাণে বুঝেছিলেন বিধায় এ বিশ্বর সাড়ে আটশ’ কোটির জীবনমান এবং আগামীদিনের কথা চিন্তা করেই থ্রি জিরো তত্ত্বের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ২৮ মে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সামাজিক ব্যবসা দিবস উদ্যাপনকালে প্রধান বক্তার বক্তৃতায় তিনি এ তত্ত্ব তুলে ধরেন। ২০১৭ সালে প্রকাশিত World of Three Zeros নামক গ্রন্থে তিনি পৃথিবীর তিনটি বড় চ্যালেঞ্জের সমাধানের ব্যাপারে বিশ্ববাসীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি সালে (২০২৪) ২৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ভাষণে শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস থ্রি জিরো নিয়ে কথা বলেন। তাছাড়া ১৩ নভেম্বর (২০২৪) জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে নতুন বিশ্ব গড়তে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনেও (কপ ২৯) ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
আসলে ‘থ্রি জিরো’ বা ‘তিন শূন্য’ তত্ত্বটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আড়ালে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে নতুন বিশ্ব গড়তে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আর এই তত্ত্বের মাধ্যমে ড. ইউনূস একটি সমতাভিত্তিক ও স্থিতিশীল ধরণির ধারণা তুলে ধরেছেন; যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশগত সুরক্ষা যুগপৎ একই ধারায় চলবে। আর এই তত্ত্বে যে তিনটি প্যারামিটার অগ্রগামী হবে, তা হলো (i) শূন্য দারিদ্র্য (Zero Povery), (ii) শূন্য নিট বেকারত্ব (Zero Unemployment) এবং (iii) শূন্য কার্বন নির্গমন (Zero Net Carbon Emissions)।
প্রথমত, শূন্য দারিদ্র্যের ব্যাপারে তিনি উল্লেখ করেন, দারিদ্র্য কোনো স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক অবস্থা নয়, বরং এটি একটি মানবসৃষ্ট (Manmade) অবস্থা, যা সম্পদের অসম বণ্টনের ফলস্বরূপ তৈরি বৈ কিছু নয়। কেননা, দারিদ্র্য নিরসনের জন্য আমাদের প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন (Reform) করতে হবে। তাই এক্ষেত্রে মাইক্রোফাইন্যান্স ফলপ্রসূ উদ্যোগ। এ ব্যাপারে তিনি দারিদ্র্য দূরীকরণে গ্রামীণ ব্যাংকের বৈপ্লবিক উদাহরণ টেনে আনেন। এ প্রেক্ষাপটে সামাজিক ব্যবসার ওপর গুরুত্বারোপ পূর্বক তিনি বলেন, এর মাধ্যমে দরিদ্রদের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ উন্মোচিত হবে, যেখানে লাভের চেয়ে সমাজের কল্যাণ বেশি প্রাধান্য পাবে।
দ্বিতীয়ত, শূন্য বেকারত্ব ব্যাখ্যা করার প্রাক্কালে তিনি উল্লেখ করেন যে, উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মসংস্থান করা সম্ভব। আর মানুষকে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ ও প্রয়োজনীয় অর্থায়নের যদি ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একটি স্বাবলম্বী জীবিকা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
তৃতীয়ত, ড. ইউনূস শূন্য নিট কার্বন নির্গমন বিষয়ে উল্লেখ করেন যে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য। এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর জোর দেন তিনি। একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (Sustainable Development Goal) ক্ষেত্রে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘থ্রিজিরো’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বদ্ধপরিকর। আর তাঁর থ্রি জিরো তত্ত্বের ধারণা বাংলাদেশের তরুণদের ক্ষমতায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কৃষি খাতে একটি নতুন বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, টেকসই উন্নয়নের সব সূচকে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে থ্রি জিরো সম্পূরক অনুঘটন হিসেবে ভূমিকা রাখবে। মজার ব্যাপার হলো, এই তত্ত্ব দিয়েই ড. ইউনূস বসে নেই। তিনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই এই তত্ত্বের স্লোগান মুখ্যরূপে তুলে ধরছেন।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, প্যারিসে ২০২৪ সালের অলিম্পিকের মূল বার্তা ছিল নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘থ্রি জিরো’। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস আয়োজনে এ তিন বিষয়কে মূল ভূমিকায় রেখে সব পরিকল্পনা করা হয়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে এবারের অলিম্পিকের জন্য বেছে নেওয়া হয় প্যারিস শহরের অন্যতম অনুন্নত অঞ্চল সেইন্ট ডেনিসকে। কেননা, কার্বন দূষণ কমাতে সেখানে রাখা হয়নি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের বাড়তি ব্যবস্থা। তাছাড়া ইন্টেরিয়র ডিজাইন এমনভাবে করা হয়, যাতে বাইরের তাপমাত্রা থেকে ভেতরের তাপমাত্রা অন্তত ছয় ডিগ্রি কম থাকে। এতে প্রতি স্কয়ার মিটারে ৩০ শতাংশ কম দূষণ হয়। একই সঙ্গে কার্বন মেশানো কংক্রিটের বদলে কাঠ ব্যবহারের প্রবণতাও পরিলক্ষিত হয়। এদিকে খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ও ড. ইউনূস যৌথভাবে ইতালির রোমে ‘পোপ ফ্রান্সিস-ইউনূস থ্রি জিরো ক্লাব’ চালু করেন। আসলে এটি মানবতার জন্য একটি রূপান্তরমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের সূচনা করার প্রয়াসের গঠনমূলক উদ্যোগ। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, এর মধ্যে বিশ্বজুড়ে অন্তত ৪,৬০০টি থ্রি জিরো ক্লাব রয়েছে, যার সবই প্রফেসর ইউনূসের থ্রি জিরো স্বপ্নের আদলে সংগঠিত। এই তত্ত্বের জনক ড. ইউনূস উল্লেখ করেন, এই থ্রি জিরো বাস্তবায়নের জন্য চারটি প্রপঞ্চ বা নিয়ামক আবশ্যক। যা হলো * তরুণদের শক্তি এবং সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানো * প্রযুক্তির শক্তি ব্যবহার * ব্যবসাকে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তর * সুশাসন নিশ্চিত করা। পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, মানব কল্যাণে ড. ইউনূসের এই প্রায়োগিক তত্ত্ব সফলপূর্বক বিক্ষুব্ধ বিশ্ববাসীর মধ্যে সুখ শান্তি ফিরিয়ে আনবে। তবে এই তত্ত্ব ফলপ্রসূ করতে বিভিন্ন আঙ্গিকে এগিয়ে আসতে হবে বিশ্ববাসীকে।
লেখক : গবেষক, অর্থনীতিবিদ
[email protected]/w.goonijon.com