ব্রিটিশরা অতি সুকৌশলে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির মাধ্যমে ভারতবর্ষকে ভাগ করেছেন। একটির কনভেনশনের মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়েছিল পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানের মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার হরণ এবং একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। সাতচল্লিশের পর দীর্ঘ চব্বিশটি বছর সে পথেই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন পাকিস্তানের শাসনকর্তারা। ’৫২ সালে ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর যে আঘাত এসেছিল ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর তা আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করে। এদেশের মানুষকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে দাবিয়ে রাখার পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রগুলো তাদের সাম্প্রদায়িক নীতি ও মনোভাবের ফলে ল্ডমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যায়। পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর মেধা ও মননকে ধ্বংস করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলে। যার ফলে তখন হিন্দু মুসলিম কারও প্রতিভা একটি মুক্ত পরিমণ্ডলে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। তারপরও নানা প্রকার প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে যারা অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন, তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমেদ, বঙ্গবন্ধু প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বিপ্লবী ভাষণ এদেশের মানুষের মুক্ত চেতনাকে যেভাবে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল, তারই ফসল মুক্তিযুদ্ধ, অতঃপর স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে আসেনি। হাজার বছরের লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে বাঙালি জাতির সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার বিজয় গাঁথা। সেদিন বাঙালি জাতিসত্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সকলেই এক মঞ্চে, এক লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন বলেই, এত অল্প সময়ে বাংলার স্বাধীনতা এসেছে। একাত্তরের লাখো শহীদের আত্মবলিদানের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি সামরিক শাসনের পরিবর্তে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় উগ্র সাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে ধর্ম নিরপেক্ষতা, শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই দেবদাস চল্ডবর্তীর একটি বিখ্যাত পোস্টারে লেখা ছিল, বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, বাংলার বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আমরা সকলেই বাঙালি। সেই একই কথা ভিন্নভাবে উচ্চারণ করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর একাধিকবার বলেছেন, দেশের কোন মানুষকে বাদ দিয়ে নয়, সকলকে একসঙ্গে নিয়েই আমরা একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাই। বাংলাদেশে ধর্মহীনতা নেই, নিরপেক্ষতা আছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানেই ধর্মহীনতা নয়, যা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। যে যার মতো করে যার যার ধর্ম পালন করবে, কারো ধর্মে কোনো বাঁধার সৃষ্টি বা বল প্রয়োগ করা যাবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করা যাবে না। এর অর্থই হচ্ছে ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। কিন্তু যে দেশটি হিন্দু-মুসলিমসহ সকলের অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে, সে দেশটি আজও সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা, রামু, নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, রংপুরসহ সহিংস হামলার চালচ্চিত্রই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার অপকর্মের দোষররা। তখন দেশ ছিল একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং ধ্বংসের দারপ্রান্তে। সেই উত্তাল, উত্তপ্ত পরিস্থিতির মাঝে সকলের গ্রহণযোগ্য বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি এবং তার উপদেষ্টাগণ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেশকে একটি সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যেতে কাজ করছেন। বিভিন্ন সেক্টরে চলছে সংস্কার কাজ। ল্ডমান্বয়ে নিত্যপণ্যের দাম মানুষের ল্ডয়-ক্ষমতার মধ্যে আসতে শুরু করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢেলে সাজিয়ে নতুন উদ্যমে কাজে লাগিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো ধৈর্য ও নমনীয়তার সঙ্গে এ সরকারকে সহযোগিতা করছে। দেশের মানুষ এখন তাকিয়ে আছে একটি গণতান্ত্রিক প্রল্ডিয়ার মাধ্যমে নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে দেশবিরোধী একটি কুচল্ডী মহল জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদদের আত্মত্যাগ ও নতুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে সাম্প্রদায়িক উসকানির মদত যোগাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে সনাতনী জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার ও জামিন না দেওয়ার প্রতিবাদে একজন আইনজীবীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে সবাই উদ্বিগ্ন। জুলাই গণহত্যার রেশ কাটতে না কাটতে এরকম একটি হত্যাকাণ্ড ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেশের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, নৈরাজ্য সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত যে কোনো ধর্ম, সম্প্রদায় বা দলের যত বড় ব্যক্তি হোক না কেন তার নিরপেক্ষ সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিচার হওয়া দেশের স্বার্থেই প্রয়োজন। প্রসঙ্গল্ডমে বলতেই হয়, সাবেক সরকারের আমলে নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া এ ধরনের ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। বরং উল্টো ভিকটিমদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। অতীতের ঘটনাবলীর সঙ্গে কে বা কারা জড়িত ছিল তা বিগত সরকার স্বচ্ছতা ও সততার সঙ্গে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে দেশী-বিদেশী নেপথ্যের নায়করা আজও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ পাচ্ছে। এদেশের শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী আশা করে এবং বিশ্বাস করে যে, যেহেতু এ সরকার কোনো দল মতের নয়, সেহেতু নিরপেক্ষতার মাধ্যমে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী দ্রুত নিরসন করে দেশের সম্প্রীতি যাতে বজায় থাকে সেদিকে অগ্রসর হবেন। দেশের প্রতিটি নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। তাই আইনি প্রল্ডিয়ার মাধ্যমেই বিদ্যমান অবস্থার সমাধান হবে এমন আস্থা সংখ্যালঘুদের আছে। একটু পরিষ্কার করে বলা যায়, দলীয় সরকারগুলো যখন রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে থাকে, তখন নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার জন্য যেসকল প্রতিশ্রুতি দেন, ক্ষমতায় গেলে তা ভুলে যান। ভুলে যান বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস, সংবিধান ও গণতন্ত্রের কথা। সংবিধানের প্রারম্ভে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। তাই সাংবিধানিক অধিকার বলেই হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলেরই সমান অধিকার ভোগ করবে, একথা সংবিধানে স্পষ্ট করা হয়েছে। কোনো ধর্মই মানুষের ওপর জুলুম নির্যাতনকে প্রশ্রয় দেয়নি। ইসলামসহ প্রতিটি ধর্মেই শান্তি ও মানবতার কল্যাণের কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি ধর্মের একই মর্মবাণী কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে। গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে শ্মশান গোরস্তান এক হয়ে গেছে জীবনের সব বাধা ব্যবধান। তাই সকল বাধা ব্যবধান ঘুচিয়ে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষে-মানুষে সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধন গড়ে তুলতে হবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের দাবি-দাওয়াগুলো পূরণে আন্তরিক হবে এমনটাই প্রত্যাশা। এদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করে বলেই হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু-মুসলিমের সহাবস্থান আজও দৃশ্যমান। বাংলাদেশের হিন্দুরা কোনো উদ্বাস্ত নয়, তারা এদেশের ভূমিপুত্র। বংশ পরম্পরায় এদেশে তাদের চৌদ্দ পুরুষের বসবাস। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর গণআন্দোলন ও জুলাই-আগস্টের বিপ্লবসহ যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে। এ বছর দুর্গাপূজায় সরকার যেভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে এবং দেশের মানুষ আন্তরিকতার সঙ্গে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তা অভূতপূর্ব। সংগত কারণেই বলা যায় ব্যক্তি সম্প্রদায় ও প্রতিষ্ঠান এক নয়। কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তার শাস্তি অবশ্যই হবে। তার জন্য একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। চিন্ময় ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে যে টানাপোড়েন চলছে, তা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মাধ্যমে সমাধান হতে পারে। ভারতের মাটিতে বসে রাজপথে ঘাম ঝরিয়ে, বাংলাদেশের পতাকা পুড়িয়ে কিংবা দূতাবাসে হামলা-ভাঙচুরের মাধ্যমে নয়। আবার বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের পতাকা এঁকে পদদলিত করেও নয়। প্রকৃতপক্ষে দুই দেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতা ও নমনীয়তাই উভয় দেশের মাটিতে স্যেকুলারিজম ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও জোড়ালো করে তুলবে- সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক : পরিবেশকর্মী