ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

পরকালীন চেতনা

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ১৯:৩২, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪

পরকালীন চেতনা

বর্তমান সমাজে ‘চেতনা’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। যে কোন ব্যাপারে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক কার্যপরিসরে মৃতপ্রায় ও উদাসীন এ সমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য আমরা ‘চেতনা’র প্রয়োগ করি। কিন্তু একটি বিশেষ চেতনা জাগরূক করতে পারলে আমাদের হাজার অচেতন অবস্থা কেটে যেত। মানুষ ধনের প্রতিযোগিতা, মানের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতো না, অবতীর্ণ হতো সত্যনিষ্ঠ ও আমানতদার প্রমাণের প্রতিযোগিতায়। কিভাবে সততার সঙ্গে অল্পে তুষ্ট থেকে জীবন কাটানো যায় তা খুঁজে বের করত সচেতন মানুষ। ফলে লাভ হতো যে, প্রতিযোগিতার বাজারে দুর্বল শ্রেণী মাঠে মারা যেত না, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার লোভ ও স্বার্থে মানুষ যা-তা করার সাহস পেত না। মস্তান কমত, দুর্নীতি আর দুর্নীতিবাজ দুটোই নিপাত যেত। লোকেরা আপনাতে আপনি মগ্ন হতো, অন্যের অনিষ্ট চিন্তা না করে ত্যাগী মনোভাব নিয়ে সমাজ সুন্দরে অবদান রাখত। সে বিশেষ চেতনাটি হলো আখিরাতের ভয় বা পরকালীন চেতনা। মনে মনে এ হিসাবটা বার বার করে দেখা যায় যে, আমার সুনির্দিষ্ট এ দুনিয়াবি জীবনের পরে বহুত কষ্টার্জিত ধনসম্পদ আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকছে কিনা। বস্তুত দেখা যায় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বাদশা থেকে নগণ্য ফকির পর্যন্ত জন্মকালীন সময়ে যে অসহায় অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়, ঠিক একই অসহায় ও নিঃস্ব বদনে ভূগর্ভে (মাটির নিচে) চলে যেতে হয়। সে এক মহত্ত্বের চেতনা শক্তির অভাবে বনি আদম আজ পথভ্রষ্ট, দিগ্ভ্রান্ত, ধন-বৈভবের প্রতিযোগিতায় এখন মানুষ না পারছে নিজের জন্য চিন্তা করতে আর না পারছে অন্যকে সাহায্যের হাত বাড়াতে। মানব জীবনের এ এক বড় ত্রুটি বড় বোকামি বৈ কিছু নয়। অনেক আগের একটি কাহিনী আজও সমাজের মুরব্বি শ্রেণির মুখে শোনা যায়। কোন এক বাদশা তাঁর বাঁদিকে খুব ভালবাসতেন। এ ভালবাসার উপহারস্বরূপ তিনি বাঁদিকে একটি শাহী ক্ষমতা দান করলেন। ক্ষমতাটি হলো : যদি তুমি কোনো বোকা লোক পাও তবে তার মুখে থুতু নিক্ষেপ করবে। এরপর থেকে থুতু খাওয়ার ভয়ে শাহী মহলে সবাই চিন্তা-ভাবনা করে চলতে লাগল। এমনকি শিক্ষিত পণ্ডিতরাও বেশ সতর্ক। বাঁদি কোথাও বোকা লোক পেল না যার মুখে থুতু ফেলা যায়। একদিন বাদশা কঠিন অসুখে। তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। সবাইকে ডেকে ডেকে আখেরী বিদায় নিচ্ছেন। বাঁদিকেও ডেকে বিদায় চাচ্ছেন তিনি। বাদশা বলছেন : বাঁদি আমি চললাম। বাঁদি আরজ করলেন, বাদশাহ নামদার, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে বাদশা : আমি এমন জায়গায় যাচ্ছি যেখান থেকে কেউ কোনো দিন ফিরে আসে না। বাঁদি : বাদশা সালামত! আপনার সঙ্গে সেবা কাজের বাঁদি, লোকজন, বিছানাপত্র, সৈন্যসামন্ত, তখত ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে? বাদশা বললেন : না বাঁদি! ওখানে দাস-দাসী, সৈন্যসামন্ত, লোকজন, বিছানাপত্র কিছুই নেয়া যায় না। তবে যে জিনিসের বিনিময়ে এগুলোর চেয়ে বেশি দামী বিছানাপত্র, সেবিকা, আরাম আয়েশ পাওয়া যায় আমি তো তার কিছুই সংগ্রহ করিনি বাঁদি। আমি যে আজ রিক্তহস্ত। এত কিছু থেকেও আজ শূন্য হাতে আমাকে বিদায় নিতে হচ্ছে। আমি জীবনে এত বোকামি করেছি। আজ আমি বুঝতে পেরেছি আমার মতো বোকা আর একটিও নেই। বাঁদি : বাদশা মহান! আজ থেকে বারো বছর আগে আপনি আমাকে থুতু নিক্ষেপের ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন। আমি এত দিন তেমন কোন বোকা লোক না পেয়ে সেই ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেনি। আজ আমি বুঝতে পারছি আপনি সে বোকা। এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে আরাম আয়েশের জন্য আপনার যা দরকার এ সবই আপনি করেছেন, বরং অনেক বাড়িয়ে করেছেন। দাসী দরকার একজন, জোগাড় করেছেন হাজার জন। হাতি-ঘোড়া, দালানকোটা সব করেছেন এরূপ। অথচ চিরকাল যেখানে থাকতে হবে সেখানকার জন্য আপনি কিছুই করেননি। তাই আপনি সে বোকা শ্রেষ্ঠ-যার মুখে এই অধম বাঁদি থুতু নিক্ষেপ করতে পারে! কুরআনুল কারীমে এসেছে : ‘হে মানুষেরা! তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করে নাও। তবে মনে রেখো যে, তাকওয়াই হলো উত্তম পাথেয়।’ তাকওয়া মানেই হলো পরকালীন জবাবদিহিতার মানসিকতায় উজ্জীবিত হয়ে হালাল হারাম বাছ বিচার করে চলা। আসলে দুনিয়ার বুকে খুব নগণ্য পরিমাণ মানুষই পরকালকে অস্বীকার করে। অপর পক্ষে প্রায় সকলেই আখেরাতকে মানুষের অবধারিত চিরস্থায়ী মঞ্জিল হিসেবে বিশ্বাস করে। কিন্তু সমস্যা হলো কাজের মাঝে এ বিশ্বাস সংরক্ষণ করে না। এতেই বিপত্তি। আখেরাতের জন্য তো বটেই, দুনিয়ার সুখ-সৌন্দর্যের জন্যও চাই পরকালীন সচেতনতা সর্বক্ষণ। আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে বলেন- অনন্তর যে ব্যক্তি দুনিয়াতে বিন্দু পরিমাণ নেক আমল করবে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে ব্যক্তি বিন্দু পরিমাণ বদ আমল করবে সেও তা দেখতে পাবে। (যিলযাল : ৭-৮) আর পার্থিব জীবন তো খেলা ও তামাশা ব্যতীত কিছুই নহে, আর মুত্তাকিদের জন্য পরকালের বাসস্থানই উত্তম, তোমরা কি ভেবে দেখ না? (আনআম ৩২) সেদিন অবশ্যই আসবে যখন মুত্তাকি লোকদের আমি মেহমানের মতো রহমানের দরবারে উপস্থিত করব। আর পাপী অপরাধী লোকদের পিপাসু জানোয়ারের মতো জাহান্নামের দিকে তেড়ে নিয়ে যাব। সেই সময় লোকরা কোনো সুপারিশ করতে সক্ষম হবে না- তারা ব্যতীত যারা রহমানের দরবার হতে প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে। (মরিয়ম ৮৫-৮৭) পরকালের ঘর তো আমি সেই সব লোকের জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে দেব, যারা জমিনে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চায় না এবং বিপর্যয় সৃষ্টি করতেও চায় না। আর পরিণামের চূড়ান্ত কল্যাণ কেবল মুত্তাকি লোকদের জন্যই। (কাসাস ৮৩) (আজ এই লোকরা দুনিয়ার জীবন নিয়ে খুব মেতে আছে) আর যেদিন আল্লাহ তাদের একত্রিত করবেন তখন (এ দুনিয়ার জীবনই তাদের এমন মনে হবে) যেন ক্ষণিকের জন্য তারা পারস্পরিক পরিচয় লাভের জন্য অবস্থান করছিল। (তখন প্রমাণিত হবে যে) প্রকৃতপক্ষে বড়ই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সেই লোকরা যারা আল্লাহর সাক্ষাত মিথ্যা মনে করে অমান্য করেছে। আর তারা কখনই সত্য ও সঠিক পথে ছিল না। (ইউনুস ৪৫) হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) রাসূলে কারীম (স) হতে বর্ণনা করেছেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও (স্ব-স্থান হতে) নড়তে দেয়া হবে না। ১. তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে। ২. যৌবনের সময়টাকে কিভাবে ব্যয় করেছে। ৩. ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে। ৪. তা কোন্ পথে ব্যয় করেছে। ৫. সে দ্বীনের জন্য কতটুকু জ্ঞানার্জন করেছে সে অনুযায়ী আমল করেছে কিনা। (তিরমিযী শরীফ)।

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
সরথৎধভরয়@ুধযড়ড়.পড়স

×