ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

আমার ভাই আমার বন্ধু শেখ কামাল

আলমগীর সাত্তার

প্রকাশিত: ২০:৪১, ৪ আগস্ট ২০২৪

আমার ভাই আমার বন্ধু শেখ কামাল

.

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণেই কামালের সঙ্গে আমার পরিচয়মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই পরিচয় বিশেষ ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছায়মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় আমি ছিলাম ভারতীয় বিমানঘাঁটিতেসেদিন ফ্লাইং ডিউটি থাকত না সেদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে কলকাতার থিয়েটার রোডে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অফিস হয়ে ব্যারাকপুর যেতামশেখ কামাল তখন আমাদের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী সাহেবের এডিসিতাই সে ওসমানী সাহেবের অফিসের সমনে একখানা চেয়ার, একটি টেবিল এবং একটি টেলিফোন নিয়ে বসে থাকতওখানে গেলে শেখ কামালের সঙ্গে কিছু সময় আড্ডা দিলে জানতে পারতাম বিভিন্ন রণাঙ্গনে কোথায় কি হচ্ছে, বা না হচ্ছেএর পরে চলে যেতাম গড়িয়াহাটে তান্তুদার বাসায়ওই বাসায় যাওয়ার কারণ ওখানে গেলে পাওয়া যেত উকৃষ্ট পানীয়ওখানে গেলে দেখা হতো কলকাতা শহরের সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে

অল্প কয়েকদিন পর আমাদের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে নিয়ে অনেকগুলো ফ্লাইট করলামপ্রধান সেনাপতির এডিসি হিসেবে অবশ্যই সঙ্গে থাকত শেখ কামালওসমানী সাহেবকে যে ডাকোটা বিমানখানা নিয়ে বিভিন্ন সেনাঘাঁটিতে যেতাম, সেই প্লেনখানা যোধপরের মহারাজা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চলাচলের জন্য দিয়েছিলেন

অ্যারোপ্লেনখানা ছিল সত্যি সত্যি মহারাজাদের নিয়ে চলাচল করার মতো প্লেনটিতে মধ্যভাগে খুব মূল্যবান কাপড়ে আচ্ছাদিত ছয়টি সোফা সেট ছিলআর ছিল ভিআইপিদের জন্য একটি টয়লেট এবং এর বাইরে প্লেনের দুপাশে তিনজন করে বসতে পারে এমন ব্যবস্থাএসব বেঞ্চে বসত ভিআইপিদের অ্যাটেন্ডেটরা

শেখ কামাল ওই বেঞ্চগুলোতেই বসে সময় কাটাতআমরা অ্যারোপ্লেন চালনা করছিলাম ভারতীয় বিমান বাহিনীর ইনস্ট্রাক্টর পাইলট ফ্লাইট লে. সিনহা, ক্যাপ্টেন আব্দুল মুকিত এবং আমি আলমগীর সাত্তারএকসময় ফ্লাইংয়ের দায়িত্বে ছিলেন ফ্লাইট লে. সিনহা এবং মুকিতআমি প্লেনের পেছনের দিকে গিয়ে কামালের পাশে বসলামকামাল খুব হাসি খুশি মুডে ছিলতখন একটা গুজব ছিল বঙ্গবন্ধু আর জীবিত নেইইয়াহিয়া খান তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছেকামালকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে ও বলল বঙ্গবন্ধু জীবিত আছেন এবং তাকে মুলতানের একটি বাড়িতে এককভাবে রাখা হয়েছেজিজ্ঞেস করলাম, তুমি জানলে কীভাবে? সে বলল, ভারত সরকার বিভিন্ন দেশের মাধ্যমে জানতে পেরেছেতা ছাড়া এতদিনে পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরেছে যে, বাংলাদেশে তাদের পরাজয় আসন্নবাংাদেশের যে বিশাল সংখ্যার পাক সেনাবাহিনী আছে তাদের ফিরিয়ে নিতে হলে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে

আমি কয়েকদিন আগে কলকাতায় জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে বেশকিছু সময় কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম জ্যাকব ছিলেন একজন ইহুদিজানামতে, ইহুদিদের বুদ্ধি একটু বেশি হয়জ্যাকব দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্র পক্ষের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেনযুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন এবং বীরত্ব- এর জন্য খেতাব পেয়েছিলেন

আমাদের সেক্টর এবং সাব সেক্টর কমান্ডাররা কনভেনশনাল যুদ্ধের ব্যাপারে কিছুটা বুঝলেও পাকিস্তানের উন্নত মানের অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেনকিন্তু গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা কোথাও আক্রমণ চালিয়ে দু-একজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করলে পাক সেনারা ওই অঞ্চলের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত এবং একই সঙ্গে স্থানীয় লোকদের হত্যা করতফলে ওই সব অঞ্চলের যুবকরা প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করততবে শুধু গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে একটি দেশকে স্বাধীন করা যায় নাতাই জেডফোর্স, এসফোর্স, কেফোর্স নাম দিয়ে তিনটি নিয়মিত বাহিনী গঠন করা হয়ভারতীয় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এই তিন বাহিনীকে সুসজ্জিত করা হলে এই তিন বাহিনীর কাছেই পরাজিত হয় পাকবাহিনী

কামালের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করে আবার ককপিটে গিয়ে আমার আসন গ্রহণ করলামকামাল তাঁর আসনে বসে রইল এবং গুন গুন করে গান গাইছিলযুদ্ধজয়ের আমরা তখন দ্বারপ্রান্তেআর কয়েক দিনের মধ্যে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে, এ বিষয়ে সন্দেহ ছিল না

শেখ কামালের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবঙ্গবন্ধুকে হত্যার ব্যাপারে যে ষড়যন্ত্র চলছে, এই কথা বলার জন্য ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দিন (বীর উত্তম) এবং আমি  প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতাম

আমাদের ইচ্ছা ছিল কথাটা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই বলববঙ্গবন্ধুকে কথাটা বলতে শেরেবাংলা নগরে তার অফিসে আমরা দুজন যেতামঅফিসে গেলে তিনি বলতেন, দেখ কেমন ব্যস্ত আছি? বাসায় আসিস আবার বাসায় গেলে বলতেন, দেখ সারাদিন অফিসে ছিলামএখন অনেক ক্লান্ত, তোরা আরেক দিন আসিসশাহাব আর আমি বঙ্গবন্ধু কখন বাসায় আসবেন, সে জন্য অপেক্ষা করে থাকতামতিনি বাসায় আসতেন রাত ১০টার পরআমাদের বলতেন, সকাল থেকে অফিস করছিতোরা অন্য দিন আসিসকামালের রাজনৈতিক বিষয়ে আগ্রহ ছিল নাও ছিল খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্তলোকের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে আবাহনী ক্লাবটা গড়ে তুলেছিলএ ছাড়া অভিনয় করার প্রতিও ওর আগ্রহ ছিলও খুব ভালো গিটার বাজাতঅর্থ-সম্পদের প্রতি শেখ কামালের কোনো লোভ লালসা ছিল নাতাই কোনো শিল্প-কারখানা তৈরি করার চেষ্টা করেনি

শেখ কামাল আমার ছোট বোন মমতাজ এবং তখনকার  প্রখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড়ের সঙ্গে বিয়ের ঘটকালি করেছিল১৯৭৫ সালে ভয়ংকর সেই রাতে একদল সশস্ত্র লোক বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে এসে উপস্থিত হলোগেটের কাছে একজন ভদ্রলোক ছোট একখানা ঘরে থাকতেনতিনি টেলিফোনে বাসার ওপরে খবরটা দিলেনশেখ কামাল বাসার নিচে নেমে এলেনকারা এই সশস্ত্র লোক? কামাল গেট খুলে সশস্ত্র লোকদের দেখার চেষ্টা করেন ওই সময় সশস্ত্র লোকদের মধ্য থেকে একজন কামালের বুকে গুলি চালাল, সঙ্গে সঙ্গে কামাল মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ল

 লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিমান চালক,কিলোফ্লাইট

 

×