
ড. ইউসুফ খান
সবাই সুখী হতে চায়। সুখের সংজ্ঞা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন। পশ্চিমা দেশগুলোতে সুখ মানেই অর্থ সম্পদ, উচ্চ আয় এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু বিপুল অর্থ সম্পদের মধ্যেই কি জীবনের সব সুখ মেলে? সুখ অনুভূতির পুরোটাই কি অর্থ দিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব? সন্তুষ্টি লাভের পথে অর্থই কি শেষ কথা? নাকি জীবনে অন্যকিছুরও প্রয়োজন রয়েছে? মার্কিন লেখিকা গ্রেটচেন রুবিন তার ‘দ্য হ্যাপিনেস প্রজেক্ট’ বইতে লিখেছেন, অর্থ সুখ কিনতে পারে না। হয়তো ক্ষণিকের সুখ দিতে পারে। কিন্তু সবকিছু অর্থ দিয়ে বিবেচনা করা ঠিক নয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, সুখের জন্য অর্থ খুব জরুরি নয়।
তবে গবেষকরা মনে করেন, অর্থ ব্যয় করে মানুষ যে অসংখ্য জিনিস কেনে, তা তাদের সুখ অনুভূতির ওপর একটা বড় প্রভাব ফেলে। গবেষকরা আরও মনে করেন, অর্থ দিয়ে কিছু কেনায় যে শান্তি আসে, তা মানসিক চাহিদা পূরণ করে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি অর্থ ব্যয় করে কোনো কিছু কেনার মাধ্যমে সুখ অনুভব করেন, তবে তাই তার সুখ। আবার ব্যক্তি বিশেষে বদলে যেতে পারে সুখের সংজ্ঞা। অনেকে মনে করেন, অর্থ সুখ কিনতে পারে না।
যারা এ ধারণায় বিশ্বাসী তাদের নতুন করে ভাবতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়, অর্থ সুখ কিনতে পারে। আর সেই সুখ তখনই কেনা যায়, যখন মানুষ তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিল রেখে তা খরচ করে।
পার্থিব জীবনে অর্থের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। তবে জীবন চালাতে কতটা অর্থের দরকার, সেটি অবশ্য তর্ক সাপেক্ষ। অনেকে আছেন যারা অর্থ ছাড়া জীবনকে অর্থহীন মনে করেন। তারা অল্পতে তুষ্ট নন। তাদের জীবন দর্শন হলোÑ ‘দুনিয়াটা টাকার বশ’। তাই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা চাই। আবার অনেকে মনে করেন, মানব জীবনে অর্থের প্রয়োজন রয়েছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি বেশি অর্থ হয়ে উঠে সকল অশান্তির উৎস।
আসলে সুখ একটি মানবিক মানসিক অনুভূতি। অর্থাৎ সুখ মনের একটি অবস্থা বা অনুভূতি, যা ভালোবাসা, তৃপ্তি, আনন্দ বা উচ্ছ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থ সব সময় সুখ দিতে পারে না সত্যি, কিন্তু একজন লোক যখন অন্যদের চেয়ে বেশি উপার্জন করেন, তখন তিনি নিজেকে ঠিকই সুখী মনে করেন। একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, তখন সব ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়’।
তাই সুখের জন্য কি পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তা নির্ধারণেরও প্রয়োজন রয়েছে। বলা হয়, মোটামুটি ভালোভাবে চলার জন্য যা খরচ হয়, সেই ব্যয় মেটাতে পারলেই খুশি হয় মানুষ। অর্থের সঙ্গে সুখের সম্পর্ক যেমন জটিল, সঠিকভাবে সুখ পরিমাপ করাও তেমনি কঠিন।
সমাজে ধনী, গরিব, সুখী-অসুখী বিভিন্ন ধাচের মানুষ রয়েছে। তবে সুখী মানুষ খুঁজে পাওয়া সোনার পাথর বাটির মতো। সকলেই সুখী হতে পারে না। সুখী হতে হলে অঢেল সম্পদ আর প্রাচুর্য থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। নিজের যতটুকু আছে তার মধ্যে সন্তুষ্ট থেকে আনন্দ খুঁজে পেলে সুখী হওয়া কঠিন কিছু নয়। কিন্তু মানুষের তো চাহিদার শেষ নেই। সে যত পায় ততই চায়।
একজন মানুষের কত টাকা লাগে? কিংবা একটা পরিবারেরই বা কত টাকা লাগে? কত জমিজমা দরকার? খাই খাই স্বভাবেরও তো একটা সীমারেখা থাকা দরকার! ক্ষমতা আছে বলেই কি যা খুশি তাই করব? অন্যের জমি পছন্দ হয়েছে, বাড়ি পছন্দ হয়েছে, দিগন্তজোড়া মাঠ পছন্দ হয়েছে বলে সবকিছুই নিজের করে নেব? কতটুকু জমি দরকার?
রাশিয়ার বিখ্যাত লেখক লিও টলস্টয়ের একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। গল্পটির প্রতিপাদ্য হলো, ‘Hwo much land does a man require?’
একজন লোভী মানুষের জমি কেনার দিকে ছিল প্রচন্ড ঝোঁক। কারও কাছে জমির কথা শুনলেই তার চোখ চকচক করে উঠতো। কম দামে জমি বিক্রি হলে তিনি তা কিনতে মরিয়া হয়ে উঠতেন। জমির জন্য ছুটে যেতেন যেখানে সেখানে। সস্তায় যেখানে জমি পাওয়া যেত, সেখানেই গিয়ে পরিবারসহ হাজির হতেন এবং জীবনযাপন শুরু করতেন।
এভাবে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্য ঘুরতে ঘুরতে এমন এক জায়গার সন্ধান পান যেখানকার মানুষ খুব সহজ-সরল।
তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ঠকিয়ে নাম মাত্র মূল্যে বিঘায় বিঘায় জমি কেনেন। সেখানকার উর্বর জমি থেকে তার আয় দিন দিন বাড়তেই থাকে। তার আরও জমি চাই। জমির চিন্তা তাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না। ওই রাজ্যের রাজা সমুদয় বিষয় জানতে পেরে তাকে কৌশলে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। একদিন তাকে ডেকে বললেন, হে আমাদের রাজ্যের সম্মানিত অতিথি, আপনার কী আরও জমি দরকার?
তিনি তখন নির্দ্ধিধায় বললেন, হ্যাঁ, আমার আরও চাই। রাজা তখন তাকে বললেন, ঠিক আছে আপনাকে আরও জমি পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। তবে একটি শর্ত আছেÑতাহলো, সূর্যোদয়ের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যতটা পথ আপনি যেতে পারবেন, সবটুকু জমির মালিক হবেন আপনি। তবে অবশ্যই সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে ফিরে আসতে হবে।
লোকটি তো আনন্দে আত্মহারা। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু করলেন তার ছুটে চলা। যত দূর যাওয়া যায় ততটাই তার! সারাদিন তিনি দৌড়ালেন, হাঁটলেন। কোনো বিশ্রাম নিলেন না। মনে মনে একটাই ভাবনা, ‘সব জমি আমার চাই’। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। পর মুহূর্তেই ভাবলেন, এই সুযোগ তো আর জীবনে আসবে না। তাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ছুটে চললেন।
কিছুক্ষণ যাওয়ার পর হঠাৎ মনে পড়ল, আরে শর্ত অনুযায়ী সূর্যাস্তের আগেই তাকে শুরুর জায়গায় ফিরে আসতে হবে। কিন্তু হাতে তো সময় বেশি নেই। শুরু হলো পেছনে ফেরা। সূর্যের দিকে তাকাচ্ছেন আর ফেরার জন্য দৌড়াচ্ছেন। কিন্তু শরীর আর চলছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তবু হামাগুড়ি দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে গেলেন ঠিক সময়টাতে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ! এমন ক্লান্ত বিধ্বস্ত পরিশ্রান্ত দেহে প্রাণবায়ু আর থাকতে চায়নি। লোকটিকে কবর দেওয়া হলো। শেষ পর্যন্ত সে পেল সাড়ে তিন হাতের ছোট্ট একটু জমি।
এভাবেই আমাদের প্রত্যেকের জীবন শেষ হয়, কিন্তু চাহিদার শেষ হয় না। আমরা প্রত্যেকেই যেন ছুটে চলেছি অনন্ত এক চাহিদাকে সঙ্গী করে।
লেখক : চেয়ারম্যান, ব্যুরো বাংলাদেশ