ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

উৎসবপ্রিয় জাতির মিলনযজ্ঞ

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২১:০৪, ১০ জুন ২০২৪

উৎসবপ্রিয় জাতির মিলনযজ্ঞ

অপেক্ষমাণ আর এক ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা

অপেক্ষমাণ আর এক ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। মুসলমানদের শুধু পবিত্রতমই নয় বরং সর্বশক্তিমানের প্রতি উৎসর্গ আর নিবেদন। আমরা ধর্মপ্রাণ অসাম্প্রদায়িক জাতি। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষ এক সঙ্গে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে ওঠা আমাদের শুধু জাতিগত নয় চিরস্থায়ী এক মিলনযজ্ঞ বলাই যায়। তার ওপর মিলনগ্রন্থিতে যে উৎসব আয়োজন ভর করে সেটাও অস্ট্রিক জাতিসত্তার অনবদ্য সম্ভার।

বৈচিত্র্যিক হরেক সম্মিলনের সমৃদ্ধতার যে অনন্য বলয় আধুনিক প্রযুুক্তির যুগে তেমন কোনো ব্যতিক্রমী দৃশ্য সামনে আসাও শাশ্বত এক অমলিন সাধনযজ্ঞ। তার ওপর উৎসব প্রিয় জাতি আমরা। আনন্দযজ্ঞে মহামিলনের আকাক্সক্ষায় পবিত্র ধর্মীয় পর্বগুলো উদ্যাপন করি অন্তরের নির্মোহ আবেগে। তেমন এক পবিত্রতম ধর্মীয় বিধি ঈদুল আজহা।

পটভূমি হিসেবে উল্লেখ আছে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তার প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইলকে পরম করুণাময়ের নিমিত্তে উৎসর্গ করতে যখন অকুণ্ঠিত, দ্বিধাহীন তেমন অনন্যক্ষণে সর্বশক্তিমান যা করলেন সেটা বান্দার প্রতি এক অপরিসীম ঔদার্য আর রহমতের অবারিত বর্ষণ। সেখান থেকেই মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব কোরবানির রেওয়াজ শুরু বলে ইসলামের বিধিবিধানে উল্লেখ রয়েছে।

আর এই কোরবানির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত হয় ইসলামের আর এক ধর্ম সাধনা পবিত্র হজপালন। সেখানে আরও কিছু বিষয় সংযোজন অনন্য এক আধ্যাত্ম দর্শন। আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন মানুষদের জন্যই হজ এবং কোরবানি দুটোই অবশ্য পাালনের মধ্যে এসে যায়। আর অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি যারা কোরবানি দেবেন সেখানেও ধর্মীয় বিধিতে নির্দেশনা দেওয়া আছে।

অসঙ্গতিসম্পন্ন আত্মীয়স্বজন আর গরিব-দুঃখীদের মধ্যে নিয়ম অনুযায়ী কিছু মাংস দিয়ে দিতে হবে। বাকি অংশ যিনি কোরবানি দেবেন তার কাছেই থাকা ধর্মীয় নির্দেশ। পবিত্র ধর্ম ইসলামের সাম্যবাদী চেতনা সর্বজনবিদিত। তার পরেও মানা না মানা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপরই নির্ভরশীল। তবে ধর্মীয় আয়োজনগুলো উপস্থিত হয় তার সর্ববিধ আয়োজন আর আড়ম্বরের হরেক কর্মযোগে।

আমাদের বাংলাদেশ শুধুমাত্র ধর্মীয় গাম্ভীর্যেই নয় বরং অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বিধিবিধানগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে পালন করে যায়। ঈদুল আজহা শুধু উৎসব আয়োজনই নয়, তার আগে পশুরহাট বসাও নির্ধারিত সময়ের অনন্য কর্মপ্রবাহ। কোরবানি ঈদ সন্নিকটে। পশুরহাট জমজমাট। যা ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য অনন্য এক মিলনমেলা তো বটেই।

পশুরহাটে গরু বেচাকেনায় মূল্য এক অবধারিত বিষয়। বিক্রেতারা অতি অবশ্যই ক্রেতা সাধারণের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন দামের গরু-ছাগল হাটে নিয়ে তাদের বিকিকিনির সম্ভার সাজায়। গরুর মূল্য সেখানে কয়েক হাজার থেকে লক্ষাধিকে উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া ব্যবসা বাণিজ্যের অতি স্বাভাবিক পালাবদল। হাটে বাজারে গরু-ছাগলই থাকে বিকিকিনির অনন্য উৎস। তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না এমন ভিড়ে।

ক্রেতারাও উন্মুখ হয় সাধ্যমতো কোরবানির পশুর দর-দামে। পছন্দের পশু হাতের কাছে পাওয়া গেলে মোটামুটি কেনার আগ্রহ তৈরি হয়। শেষ দিকে ভিড়ের আধিক্যে ক্রেতা-বিক্রেতার হিমশিম খাবার দুরবস্থা। হাটে-বাজারের এমন অবস্থা সেখানে বসতভিটার ভূমিকাও উল্লেখ করার মতো। বাড়িতেও শুরু হয়ে যায় তোড়জোড়। সেখানেও যেন উৎসবের অভাবনীয় আমেজ।

পশু আসার আগে রাখার জায়গা ঠিক করাও অত্যাবশ্যকীয় কাজ। যা শুরু করতে বিভিন্ন পরিবার যেন প্রস্তুতি থেকে আরম্ভ করে প্রাসঙ্গিক হরেক ব্যবস্থাপনাও নজরদারিতে নিয়ে আসে। দা, বঁটি, ছুরিতে শাণ দেওয়া থেকে মাংসের জন্য উপযুক্ত করতে বাড়ির গৃহস্থের যে আরেক কর্মযোগ তাও ধর্মীয় বিধি ব্যবস্থার এক পর্যায়ক্রমিক ধারা বলাই যায়।

কোরবানির সময়ে সংসারের গৃহিণীদের ব্যস্ততম সময় পার করতে হয় সবচেয়ে বেশি। পারিবারিক আঙিনায়ই কোরবানির বিভিন্ন কাজ-কর্ম সামাল দিতে হয়। সবার আগে গরু-ছাগলের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা গুছিয়ে রাখাও নিয়মিত কাজ। যে কয়দিন রাখতে হয় খাবারের আয়োজন করাও জরুরি গরু-ছাগলের জন্য। বেশ ঝক্কিঝামেলা তো পোহাতেই হয়। গৃহকর্ত্রীর কঠোর নজরদারিতে সব কিছু হয়ও না।

গরু-ছাগল বলে কথা, পশুদের ক্ষণিক সময়ের জন্য পোষ মানানো কঠিনতর বিষয়। যার সঙ্গে গৃহপালিত পোষা প্রাণীদের তেমন কোনো মিলই থাকে না। অজানা-অচেনা পরিবেশে এসে প্রথমে পশুরাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অস্থির। অনেক কিছু সামলানোর পর উপস্থিত হয় ঈদুল আজহার পরম শুভক্ষণটি। অনেকে গরু-ছাগলের গলায় ছুরি বসানো পর্যন্ত কোনো কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকে।

সেটা নাকি যাদের নামে কোরবানি তাদের জন্য। একটা রোজার সওয়াব বর্ষিত হয়। এমন কথা আমাদের সমাজে শুনে শুনে বড় হওয়া। ছুরি গলায় বসে গেলে তারপর আরম্ভ হয় মাংস থেকে চামড়া আলাদা করার বিষয়টি। এখানেও থাকে গরিব-দুঃখীর হক। চামড়া বিক্রির পুরো টাকাটাই দুস্থ মুসলমানের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়।

যেহেতু আমরা উৎসব সমঝদার জাতি সে কারণে পবিত্র ঈদ পালন করতে আরও মুখরিত পরিবেশে গ্রামবাংলায় যাওয়ার দৃশ্যও এক অবারিত অনন্য কর্মসংযোগ। সেটাই সবচেয়ে বড় বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখনো আধুনিক বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলই পল্লি জননীর অবারিত রূপ, রস গন্ধে ভরপুর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ‘আমার শহর আমার গ্রাম’ যে অনন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে অবারিত করলেন তাও বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ এই অঞ্চলের গ্রাম শহরের বৈষম্য, দূরীকরণে অনন্য এক যাত্রা। সেখানে শহরের হরেক সুযোগ সুবিধায় গ্রামকে আধুনিক করা। বিপরীত দিকে ঐতিহ্যিক গ্রামবাংলার পিঠে-পুলির হরেক সৌরভে নগর জীবনকে অনন্য মাত্রায় ভরে তোলা।

সত্যিই এক অভাবনীয় বৃহত্তর কর্মযোগে নাড়ির টান আর আধুনিক প্রযুক্তির বসতিকে যেন মিলে মিশে একাকার করে দেওয়া। বৈচিত্র্যিক এমন কর্মযোগে শুধু অবকাঠামো উন্নয়নই নয় বরং দুই বিপরীত মেরুকে সহাবস্থানে নিয়ে আসার পরম নির্মাল্য তো বটেই। আর উৎসব আয়োজনও এমন সব ঐতিহ্যিক ও আধুনিকায়ন থেকে আলাদা একেবারেই নয়। যা আমাদের ধর্মীয় উৎসবকেও নিত্যনতুন মাত্রায় অভিষিক্ত করতে সব সময় এগিয়েই থাকছে।

আজ যেমন গ্রামগঞ্জে বিদ্যুতের আলোয় উদ্ভাসিত একইভাবে আধুনিক নগরায়ণ ও পল্লি বালার পিঠে উৎসবের অনন্য কর্মযজ্ঞকে সমানভাবে মাতিয়ে দিচ্ছে। কোরবানির প্রসঙ্গে এমন সব দৃশ্যমান আলোকোজ্জ্বল অধ্যায় যেন মিলিত এক সৌরভ যা আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশকে নতুনভাবে চিহ্নিত ও হরেক প্রকল্পে এগিয়ে নিচ্ছে। আরো এক অসহনীয় চিত্র প্রতিকারের মতো এবারও উঠে আসা অস্বস্তিকর।

কোরবানির অতি প্রাসঙ্গিক মাংসের মসলার উপর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কালো হাত। দাম বেড়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলেই দিশেহারা। তারপরে বেশি মূল্যেই কিনতে হচ্ছে গ্রাহকদের। ধর্মীয় বিধিতেও কালোবাজারীর নগ্ন থাবা।
কিন্তু এতসব ব্যবস্থাপনা অবিচ্ছিন্ন থাকলেও নাড়ির টানে দুই ঈদেই গ্রামের বাড়ি যাওয়া চিরাচরিত ঐতিহ্যিক সোপান। সেখানে সবার আগে ভাবতে হয় গ্রামে যাওয়ার টিকিটের বিষয়টি। সেটাও যে কত ঝক্কিঝামেলার মধ্যে সময় পার করে তা সংশ্লিষ্টদের যাত্রা দুর্ভোগ বললে বেশি নয় কিন্তু। প্রথমেই শুরু হয়ে যায় অনলাইন টিকিট বিক্রির কার্যক্রম।

টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রেও কালোবাজারির থাবা থেকে ধর্মীয় উৎসবগুলো বিচ্ছিন্ন থাকে না। মহৎ ধর্মীয় আয়োজনে অসাধু ব্যবসায়ীদের যে নগ্ন থাবা টিকিটের ওপর তা জানা-বোঝার এক অজানা বিস্ময়। রাজধানী ঢাকা ইতোমধ্যে শুধু উন্নয়নযজ্ঞই নয়, সংশ্লিষ্ট আবর্জনায় বিপন্ন অবস্থার শিকার। সম্প্রতি রেমালের আঘাতে তেমন অসহনীয় দৃশ্য উঠে আসতে দেরি হয়নি।

অনেক উন্নয়ন মহা প্রকল্প এখনো শেষ অবধি তার কর্মযোগকে অবারিত করতে বিভিন্ন সময় নাজেহালের অপদৃশ্য সত্যিই পীড়াদায়ক। স্বল্প বৃষ্টিতে পানি জমে থাকাই শুধু নয়, সীমাহীন যানজটের কারণে যাত্রীদের কত দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা বর্ণনারও অতীত। আবার এমন সব দুর্বিপাকের মধ্যেই কোরবানির হাট থেকে পশু নিয়ে আসা আর এক বিপত্তিকর দুরবস্থা। এটা শুধুমাত্র রাজধানীর চিত্র নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন নগর, বন্দর, শহরে সমান দুর্দশা।

মাত্রাতিরিক্ত বড় যন্ত্রযানের সীমাহীন জট পাকানোর বিসদৃশ্য নতুন কিছু নয়। চলমান ও ঘটমান বিরূপ পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়াই সংশ্লিষ্ট জনগণের এক অসহনীয় বিপাক। সবচেয়ে কষ্টদায়ক বিষয় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কোরবানি দেবে তেমন অবস্থা অনেকেরই হয় না। সময়মতো পৌঁছানো যেখানে এক বিপরীত মেরুকরণ। সেখানে ঈদ উৎসবের চিন্তা মাথা থেকে বেরও হয়ে যায়।

বরং আনন্দ-উল্লাস নয়, কোনোমতে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে পারলেই যাত্রীরা যেন হাফ ছেড়ে বেঁচে যান। তেমন অসময় কত যে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় সেটা কোনো হিসাবের মধ্যেই আসে না। তার ওপর বিপন্ন সড়কের নানামাত্রিক অশান্তিও ঘিরে ধরে যাত্রীদের। আগে থেকেই সড়কগুলো চিহ্নিত করে নতুন ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেবার বিষয় গণমাধমে উঠে আসলেও বাস্তব প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

চারপাশে খানা-খন্দ ছাড়াও নির্মাণাধীন হরেক প্রকল্পের আবর্জনা ও দীর্ঘ সড়ক আর যাত্রাকে যে দুঃসহ ভোগান্তিতে ফেলে দেয় তাও ঈদ আনন্দ উৎসবের অসহনীয় যন্ত্রণা। যাত্রীরা কোনোভাবেই স্বস্তি আর নিঃশঙ্ক থাকতেই পারে না। এমন সব দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে আরও যে ভয়ংকর অবস্থা তৈরি হয় পথ-দুর্ঘটনার তার হিসাবও মেলানো ভার। অস্বস্তিকর যাত্রা বরাবরের মতো এবারও ঘরমুখো মানুষদের কত বিপন্নতায় ঘাড়ে চেপে বসবে তেমন জবাবও সময়ের কাছেই।

নিত্যনতুন উন্নয়ন কর্মযোগে দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার বিপরীত দুর্ভোগও নিত্য তাড়া করে ফেরে অসহায় সাধারণ মানুষকে। তার পরও ঈদ আনন্দে মেতে উঠতেও সময় লাগে না। ঈদ মানেই ধর্ম, সংস্কৃতি, চিরায়ত আচার আচরণÑসব মিলিয়েই আমাদের যেমন উৎসবপ্রিয়তা। পাশাপাশি আধ্যাত্ম অনুভব আর চেতনারও অবিমিশ্র অবধারিত সম্মিলনের মহাসমারোহ।

লেখক : সাংবাদিক

×