
ভুট্টার আবাদ
এমন এক সময় ছিল, যখন দেশে ভুট্টার চাষাবাদের কথা কল্পনাও করা যেত না। অথচ এখন প্রতিনিয়তই ভুট্টার চাষাবাদ বাড়ছে। চরাঞ্চলের বালু চরে এখন চাষ হচ্ছে ভুট্টার। স্বল্প পানিতে এবং কম খরচে ভুট্টার ফলন ভালো হওয়ায় দিন দিন চাষিরা ভুট্টা চাষে বেশি ঝুঁকছেন। কয়েক বছর আগেও কুড়িগ্রাম জেলার প্রায় চার শত চরে তেমন কোনো ফসল হতো না।
কিন্তু এখন সব চরেই ধান, পাট, গম, সবজির পাশাপাশি ব্যাপকভাবে ভুট্টার চাষাবাদ হচ্ছে। ভুট্টা চাষাবাদ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন ভুট্টা চাষিরা। ভুট্টার চাষাবাদ শেষে এর কাণ্ড এবং মোচা জ্বালানি হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বছর জেলায় ভুট্টা চাষ হয়েছিল ৯ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় এ বছর জেলায় ভুট্টা চাষে কৃষকের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ হাজার হেক্টরে। ভুট্টা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভুট্টা চাষে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ৮ হাজার টাকা।
অথচ বিঘাপ্রতি ভুট্টা উৎপাদন হয় ২৮ থেকে ৩০ মণ পর্যন্ত। এই হিসাবে দেখা যায়, এক বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করে একজন ভুট্টা চাষি লাভ করেন প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা, যা অন্য ফসল চাষাবাদ করে এত বেশি লাভ করা সম্ভব হয় না। ফলে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভুট্টা চাষাবাদে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে।
বিশেষ করে এই মুহূর্তে নদী অববাহিকার চরাঞ্চলে গেলে দেখা যায়, প্রতিটি চরে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শুধুই ভুট্টার সবুজ মাঠ। এখন ভুট্টা তোলার উপযুক্ত সময়। ফলে, প্রতিটি চরাঞ্চলে চলছে ভুট্টা মাড়াইয়ের ব্যাপক কর্মব্যস্ততা।
বিশেষ করে ভুট্টা মানুষের খাদ্য চাহিদা মোটানোর পাশাপাশি গো-খাদ্য এবং হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। প্রতিনিয়তই দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে। ফলে, মাছ-মাংসের চাহিদাও বাড়ছে, যা পূরণ হচ্ছে দেশে উৎপাদিত হাঁস-মুরগির মাংসে। আমিষের বিপুল পরিমাণ চাহিদা পূরণে পোল্ট্রি ফার্মের গুরুত্বও বাড়ছে। আর পোল্ট্রি ফার্মের প্রধান খাদ্য হিসেবে ভুট্টার কদরও বাড়ছে।
ফলে, ভুট্টার চাষাবাদও বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য, দেশে ভাতের পর আটার চাহিদা বেশি। অথচ আটার জন্য যে পরিমাণ গমের প্রয়োজন পড়ে, তার ২০ শতাংশের বেশি দেশীয়ভাবে উপন্ন হয় না। বলতে গেলে চাহিদার অবশিষ্ট অংশই আমদানিনির্ভর। এমনকি ভুট্টার আটা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপযোগী। এসব কারণে দিন দিন ভুট্টার চাহিদা যেমন বাড়ছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভুট্টার উৎপাদনও। আবার এ বছর টানা তীব্র খরার কারণে ভুট্টার ফলনে কিছুটা বিপর্যয় হয়েছে সত্য। ফলে, ভুট্টার দামও এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি।
স্বস্তির খবর হলো, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিএআরআইয়ের বিজ্ঞানীগণ ইতোমধ্যেই ৭টি উচ্চ ফলনশীল ও ১১টি হাইব্রিড ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করেছেন। উচ্চ ফলনশীল জাতের ভুট্টার ফলন হেক্টরপ্রতি ৫ টন থেকে ৬ টন হলেও হাইব্রিড জাতের ফলন ১০ টন থেকে ১২ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। মূলত আমাদের দেশে কৃষির সমৃদ্ধিতে কৃষি বিজ্ঞানীদের অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা, নানামুখী সহায়তা এবং প্রণোদনা বৃহৎজনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
মূলত রবি মৌসুমেই ভুট্টার আবাদ বেশি হয়। যদিও দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে বছরে দুবার ভুট্টার চাষাবাদ হচ্ছে। কিন্তু কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলে বোরো মৌসুমেই ভুট্টার চাষাবাদ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিগত রবি মৌসুমে দেশে ৪ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় সাড়ে ৪৮ লাখ টন ভুট্টার উৎপাদন হয়েছে। এ বছর ভুট্টার মাড়াই শেষ হলে জানা যাবে কি পরিমাণ ভুট্টার উৎপাদন হবে।
তবে নির্দ্ধিধায় বলা যায়, এ বছরও ভুট্টার উৎপাদন গত বছরের চেয়ে বেশি হবে। আমরা আশা করব, সরকার যেমন আপৎকালীন সময়ের জন্য সরকারি খাদ্য গুদামে ধান, চাল, গম নির্দিষ্ট মূল্যে সংগ্রহ করে থাকে। এসব খাদ্য শস্যের পাশাপাশি ভুট্টাকেও নির্দিষ্ট মূল্যে সরকারি খাদ্য গুদামে সংগ্রহ করলে যা দিয়ে দেশের মানুষের আপৎকালীন চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ভুট্টা থেকে আটা তৈরি করে খোলাবাজারে স্বল্প মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা নিলে গমের আটার ওপর যেমন চাপ কমবে, তেমনি স্বল্প আয়ের মানুষের পুষ্টির চাহিদাও অনেকাংশেই পূরণ হবে।
মোদ্দা কথা, আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তায় চাল, গমের পাশাপাশি ভুট্টা হতে পারে সম্ভাবনাময় একটি ফসল। ফলে, ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার আরও বেশি প্রণোদনা, সহায়তার আওতায় উন্নত মানের বীজ, সার, কীটনাশক সরবরাহের ব্যবস্থা করলে ভুট্টার আটায় পুষ্টিহীনতা অনেকাংশে কমে আসবে।
সরকার ইতোমধ্যেই রপ্তানির লক্ষ্যে কুড়িগ্রামকে ‘ভুট্টা হাব’ এলাকা হিসেবে বেছে নিয়েছে। আশা করি, এ উদ্যোগ সফল হলে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুরসহ উত্তারাঞ্চলের অনেক অঞ্চলেই ভুট্টার চাষাবাদ বৃদ্ধি পাবে।
লেখক : মাঠকর্মী