ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

‘উম্মতের জ্ঞানসমুদ্র’ মনীষী ইবনে আব্বাস (রা.)

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

‘উম্মতের জ্ঞানসমুদ্র’ মনীষী ইবনে আব্বাস (রা.)

প্রসঙ্গ ইসলাম

অনেক মহামণীষী আছেন যাদের ছেলেবেলা অপরূপ শিক্ষাপ্রদ ঘটনাপ্রবাহে সমৃদ্ধ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর প্রিয় সাহাবী ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা.) জীবনেও রয়েছে তেমনি আত্মগঠনমূলক শিক্ষা। তিনি ছিলেন ইসলামী বিষয়সমূহের মহাপ-িত। জ্ঞানী মানুষদের অনেকেই জ্ঞান-গরিমাকে অযথা পথে ব্যয় করে থাকেন।

আর এমন বহু জ্ঞানী-গুণী রয়েছেন, তাদের জ্ঞান ও বিবেককে পুরোদমে মানব কল্যাণে ব্যয় করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ছিলেন মণীষী, শিশুকাল থেকেই যার আদব, বিবেক-বুদ্ধি, আহরিত শিক্ষাদীক্ষা সবকিছু ব্যয় করেছেন পবিত্র  ইসলামের সুশোভিত বিকাশকে পরিব্যাপ্ত করার জন্য। এজন্য তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর ‘হাবর ও বাহর’ (পুণ্যবান জ্ঞানী ও সমুদ্র) উপাধি লাভ করেছিলেন। তার ব্যক্তিত্ব ও জীবন সম্পর্কে আমরা অনেকেই গাফিল।

তার ব্যাপারে বলা হয়েছে মুসলিম জাহানে ‘রাব্বানী’ বা আল্লাহকে জেনেছে এমন জ্ঞানী। বস্তুত কুরআন, হাদিস সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী, এগুলোর ব্যাখ্যা ও ভাব সম্পর্কে অধিক পারদর্শী এবং এসব বিষয়ের রহস্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিত্ব। তার জ্ঞানের ব্যস্ততা তাকে কখনো প্রভুর স্মরণ থেকে দূরে ঠেলে দেয়নি। এখানেই তার বড় কৃতিত্ব, বড় স্বাতন্ত্র্য।

তার সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) দিনে রোজাদার, রাতে ইবাদত গুজার এবং রাতের শেষ প্রহরে তাওবা ও ইস্তেগফারকারী-।’ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এমন অনুপম চরিত্র নিয়ে বেড়ে ওঠার পিছনে ছিল হযরত রাসুলে খোদা (স.)-এর দোয়া ও বরকত। মহানবীর (স.) হিজরতের মাত্র তিন বছর পূর্বে মক্কায় ইবনে আব্বাসের জন্ম। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মা উম্মুল ফজল লুবাবা তাকে নিয়ে প্রিয় নবীর (স.) কাছে যান।

আল্লাহর নবী (স.) নিজের মুখ থেকে একটু থুথু নিয়ে শিশু আবদুল্লাহর মুখে দেন। এভাবে হুজুরে আকরাম (স.) এর পবিত্র ও কল্যাণময় থুথু প্রবিষ্ট হয়। আর সে সঙ্গে প্রবেশ করে তাকওয়া ও হিকমত। সাত বছর বয়স থেকে তিনি আঁ-হযরত (স.)-এঁর সেবা ও খিদমাতে আত্মনিয়োগ করেন। অজুর প্রয়োজন হলে তিনি পানির ব্যবস্থা করতেন। নামাজে দাঁড়ালে তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে ইকতিদা করতেন এবং সফরে রওনা হলে তাঁর বাহনের পিছনে আরোহণ করতেন।

এভাবে ছায়ার ন্যায় তিনি নূরনবী (স.) কে অনুসরণ করতেন এবং নিজের মধ্যে সর্বদা বহন করে নিয়ে বেড়াতেন একটি সজাগ অন্তঃকরণ, পরিচ্ছন্ন মস্তিষ্ক ও প্রখর স্মৃতিশক্তি। খেলাধুলার বয়সী এ শিশু কখনো আবার সেদিকেই হারিয়ে যেতেন। তিনি নিজেই স্মৃতিচারণ করে বলেছেন : আমি অন্য ছেলেদের সঙ্গে গলিতে, রাস্তাঘাটে খেলা করতাম। একদিন পিছনের দিক থেকে আল্লাহর রাসুল (স.)-কে আসতে দেখলাম।

আমি তাড়াতাড়ি একটি বাড়ির দরজায় গিয়ে পালালাম। কিন্তু তিনি আমাকে ধরে ফেললেন। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন: ‘যাও, মোয়াবিয়াকে ডেকে আন।’ মুয়াবিয়া (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (স.) এর সেক্রেটারি, (পরবর্তী যুগে বহুল আলোচিত-সমালোচিত বিখ্যাত প্রশাসক)। আমি দৌড়ে তার কাছে গিয়ে বললাম : চলুন, রাসুলুল্লাহ (স.) আপনাকে ডাকছেন। নবীপতœী হযরত মায়মুনা (রা.) আবদুল্লাহর খালা হওয়ার কারণে অধিকাংশ সময় তার কাছে কাটাতেন।

অনেক সময় রাতে তার ঘরে শুয়ে পড়তেন। এ সুবাদে খুব নিকট থেকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে রাসুলুল্লাহর (স.) সাহচর্য লাভে তিনি ধন্য হন। রাতে আঁ-হযরতের (স.) সঙ্গে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় ও তাঁর অজুর পানি এগিয়ে দেওয়ার সুযোগও লাভ করেন। একবার তিনি তাহাজ্জুদ নামাজে রাসুলের (স.) এর বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলে হযরত (স.) তাকে ধরে ডান দিকে দাঁড় করিয়ে দেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) নিজের একটি ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেছেন : একদিন রাসুল অজু করার ইচ্ছা পোষণ করেন। আমি দ্রুত পানির ব্যবস্থা করি। আমার কাজে তিনি খুব খুশি হলেন। নামাজে যখন দাঁড়ালেন তখন আমাকে তাঁর পাশে দাঁড়াবার জন্য ইঙ্গিত করলেন। কিন্তু আমি তাঁর পাশে দাঁড়ালাম না। নামাজ শেষ করে আমার দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন : আবদুল্লাহ? আমার পিছনে দাঁড়াতে কিসে তোমাকে বিরত রাখল? বললাম : ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ।

আমার দৃষ্টিতে আপনি মহাসম্মানিত এবং আপনি এতোই মর্যাদাবান যে, আমি আপনার পাশাপাশি হওয়ার উপযুক্ত বলে মনে করিনি।’ এ সাবলীল উত্তর শুনে হযরত (স.) আকাশের দিকে দু-হাত তোলে দোয়া করলেন : আল্লাহুম্মা আতিল হিকমাহ- আল্লাহ আপনি তাকে হিকমত দান করুন।
মানুষের জীবনে দোয়া-বদদোয়া, আশীর্বাদ-অভিশাপের একটি প্রভাব রয়েছে। সৎকাজ এবং সন্তোষজনক আচরণের দ্বারাই মানুষ অন্যের আশীর্বাদ পেয়ে থাকে। আবার অন্যায় ও দম্ভমূলক আচরণের কারণে অনেকে অভিশাপ কুড়ায়। এক হাদিসে আছে, তিন প্রকারের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে থাকে। মুসাফিরের দোয়া, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দোয়া, মজলুমের দোয়া।

আর আমাদের প্রিয় নবী হযরত রাসুলে কারিম (স.) এর দোয়া ও নেক নজর যে কোনো মানুষের সৌভাগ্যম-িত জীবনের জন্য যথেষ্ট ছিল। এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে দেদার। বস্তুত আশীর্বাদ, সুষ্ঠু পরিবেশ এবং সাধনা থাকলে মানুষের প্রশংসায় জীবন লাভ করতে আর কোনো অসুবিধা থাকে না। গত সপ্তাহে আমরা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা.) কথা বলেছিলাম। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মহানীর (স.) ওফাতের সময় তিনি ছিলেন মাত্র ১৩/১৪ বছরের বালক।

এ সংক্ষিপ্ত সময়টুকুনের মধ্যেও তিনি নবীজীর (স.) দোয়া ও সন্তুষ্টি অর্জনে ধন্য হয়েছিলেন। কারণ তার সেবা, আন্তরিকতা ও অনুসন্ধিৎসু মন। আজো তিনি বহু কারণে বিখ্যাত ও অনুসরণীয় হয়ে আছেন। আমাদের যে কোনো মুরব্বিদেরও উচিত, সর্বদা সৎ, যোগ্য ও পরিচ্ছন্ন মন-প্রাণের অধিকারী শিশু-কিশোরদের  জন্য শুভ কামনা করা। অর্থাৎ, ছোটদের কাজে উৎসাহ প্রদান এবং মূল্যায়ন।

বলছিলাম মুসলিম উম্মাহর ‘বিদ্যাসাগর’ হিসেবে খ্যাত হযরত ইবনে আব্বাসের ছেলেবেলার চারিত্রিক মাধুর্যের বিষয়ে। একবার রাতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ওজুর পানি খুঁজছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বালক আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) পানি নিয়ে সামনে উপস্থিত। হযরত (স.) প্রাণভরে দোয়া দিলেন তাকে। ‘আল্লাহুম্মা ফাককিহহু ফিদ্দীন... হে আল্লাহ তাকে ইসলামের বড় সমঝদার বানাও আর তাকে তা’বীল বা ব্যাখ্যার পদ্ধতি শেখাও।’

নবীর দোয়ার বরকতে এ হাশেমী বালক এত বেশি জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন যে, বড় জ্ঞানীদেরও তিনি ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হন। তার এমন বহু ঘটনা ইতিহাসে রয়েছে। হযরত (স.) আমলের এ বালকটি রাসুলুল্লাহর (স.) একহাজার ছয়শত ষাটটি বাণী বা হাদিস স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে মুসলিম জাতির বিশেষ কল্যাণ সাধন করেন। খলিফা ওমরের (রা.) খিলাফতকালে আবদুল্লাহ যৌবনে পদার্পণ করেন। ওমর তাকে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বড়দের সঙ্গে বসার অনুমতি দেন।

হাদিস বিশারদ ইবনে আবদীল বা’র (রহ.) বলেন : ওমর ‘ইবনে আব্বাসকে’ ভালোবাসতেন এবং তাকে সান্নিধ্য দান করতেন।’ একবার প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবীদের মজলিসে হযরত ওমর অন্যদের তুলনায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে একটু বেশি গুরুত্ব ও প্রধান্য দিলেন। (তখন আবদুল্লাহ একজন যুবক)। এ ব্যাপারে তিনি প্রবীণ সাহাবীদের সমালোচনার সম্মুখীন হন। কেউ কেউ বলেন : ‘আমাদেরও তো তার বয়সী ছেলে ও নাতি রয়েছে, আমরা তো তাদেরকে নিয়ে আসতে পারি।’

খলীফা তখন একটি কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করে আবদুল্লাহকে পরীক্ষা করেন। সে পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন। তখন ওমর বলেন : ‘আবদুল্লাহ তো বৃদ্ধদের মতো যুবক। তার আছে একটি জিজ্ঞাসু জবান ও সচেতন অন্তঃকরণ’ (আসহাবে রাসুল)। হযরত আবদুল্লাহ ছিলেন একজন আমৃত্যু জ্ঞান সাধক, বড় বিনয়ী এবং কষ্ট সহিষ্ণু। তার একটি নিজের বর্ণনা থেকে তা অনুমান করা যায়। তিনি বলেন, আমি যখন অবগত হয়েছি, জনৈক সাহাবীর কাছে একটি হাদিস সংরক্ষিত আছে।

আমি তার ঘরের দরজায় উপনীত হয়েছি। মধ্যাহ্নকালীন বিশ্রামের সময় হলে দরজার সামনে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়েছি। বাতাসে ধুলাবালি উড়িয়ে আসায় জামা, কাপড় ও শরীর হয়তো একাকার করে ফেলেছে। অথচ আমি সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে তখনই অনুমতি দিতেন। শুধু তাকে প্রসন্ন করার উদ্দেশ্যেই আমি এমনটি করেছি। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আমার এ দুরবস্থা দেখে বলেছেন : ‘আল্লাহর রাসুলের চাচাতো ভাই, আপনি কি উদ্দেশ্যে এসেছেন?

আমাকে খবর দেননি কেন, আমি নিজেই গিয়ে দেখা করে আসতাম।’ বলেছি আপনার নিকট আমারই আসা উচিত, কারণ জ্ঞান এসে গ্রহণ করার বস্তু, গিয়ে দেওয়ার বস্তু নয়। তারপর তাকে আমি হাদিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। জ্ঞানীদের যথার্থ সম্মান দান এবং নবীর (স.) শিক্ষাকে তুলে ধরার অপরূপ ক্ষমতা ছিল ইবনে আব্বাসের। একদিনকার ঘটনা। বিখ্যাত প-িত সাহাবী হযরত যাইদ বিন সাবিত (রা.) তার বাহনের পিঠে আরোহণ করবেন এমন সময় নবী বংশীয় যুবক আবদুল্লাহ মনিবের সামনে দাসের দাঁড়াবার ভঙ্গিতে তার সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং বাহনের লাগাম জিনটি ধরে আরোহণে সাহায্য করলেন।

যাইদ (রা.) তাকে বললেন : রাসুলের চাচাতো ভাই, এ আপনি কি করেছেন? ছেড়ে দিন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন : ‘আমাদের ওলামা ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সঙ্গে এরূপ আচরণ করার জন্যই আমরা আদিষ্ট হয়েছি।’ যাইদ বললেন : ‘আপনার একটি হাত বাড়িয়ে দিন’। তিনি একখানা হাত বাড়িয়ে দিলে যাইদ ঝুঁকে পড়ে তাতে চুমু খেলেন এবং বললেন, ‘আমাদের নবী পরিবারের লোকদের সঙ্গে এরূপ আচরণ করার জন্য আমরাও আদিষ্ট হয়েছি।’ ৬৮ হিঃ ৬৮৬/৮৮ খ্রিস্টাব্দে তায়ীফ নগরে বিখ্যাত ‘মসজিদে ইবনে আব্বাস’ আজও স্মৃতি বহন করে চলেছে।


লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব

[email protected]

×